ভারতের মুম্বাইয়ে টি২০ বিশ্বকাপের ম্যাচ কাভার করতে গিয়ে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের হয়রানির খবরে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দেশী গণমাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের মাঝে। হয়রানির শিকার হওয়া সাংবাদিকরা তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝির ফল উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ হাইকমিশনের দায়িত্ব সর্ম্পকে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ওই ঘটনায় দেশের জনগণ বাংলাদেশ-ভারত সর্ম্পক বিষয়ে নেতিবাচক বার্তা পেয়েছেন বলে মতপ্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
ভারতে যাওয়া সাংবাদিকরা প্রথম তিন সপ্তাহে কোনো সমস্যা ছাড়া ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গেলেও ঝামেলা বাঁধে মুম্বাইয়ে গিয়ে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল আইসিসির অ্যাক্রিডিটেশন নিয়ে বিশ্বকাপের কাজ করতে গেলেও বুধবার মুম্বাইয়ে হোটেলে ঘর ভাড়া পাওয়া নিয়ে অপমান ও হয়রানির শিকার হতে হয় চ্যানেল আইসহ বাংলাদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমের বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে।
চ্যানেল আই অনলাইনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে হয়রানির শিকার হওয়া সাংবাদিকদের খোঁজ নেয়া এবং এর সমাধানের চেষ্টা করেন। ওই অবস্থায় কী করা যেতো এবং এখন কী করা উচিৎ – এসব নিয়েও মতামত জানান অনেকে।
ওই হয়রানির শিকার হওয়া চ্যানেল আইয়ের স্পোর্টস রিপোর্টার আরিফ চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) দুপুরে হোটেলে ওঠার পর হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে পাসপোর্ট চায়। সেটা তো সব হোটেলেই দিতে হয়, এটা নিয়ে চিন্তাও ছিলো না। কিন্তু রাতেও পর্যন্ত যখন রিসেপশন থেকে পাসপোর্ট ফেরত পাইনি তখন আমি নিজে রিসেপশনে গিয়ে পাসপোর্টের খোঁজ করি। আমাকে বলা হয়, যখন হোটেল থেকে চেকআউট করবো তখন এটা দেয়া হবে।
কিছুটা চিন্তায় পড়ে যাই। পাসপোর্ট রেখে যেতে অস্বস্তিও লাগছিলো। তাই মিথ্যা বলি, ওদেরকে জানাই যে আমরা আগামীকাল সকালে (বুধবার) স্টেডিয়ামে যাবো, ওখানে খেলা কাভার করতে আমার পাসপোর্টটা লাগবে, না হলে আমি আমার কাজ করতে পারবো না। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ অনেক চিন্তা-ভাবনার পর রাজি হয় পাসপোর্ট দিতে। আজ সকালে মাঠে আসার আগে পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছি।
কেনো এমন করছে তারা – জানতে চাইলে হোটেলের লোকজন বলেছে যে, থানা থেকে হঠাৎ তল্লাশি করতে আসে এবং সে সময় তাদেরকে বোর্ডারদের পাসপোর্ট দেখাতে হয়, ফটোকপিতে তারা সন্তুষ্ট থাকে না। অনেক সময় তাদের কথামতো কাজ না করলে হোটেলকে বড় পরিমাণের আর্থিক জরিমানা কিংবা কখনো কখনো হোটেলের লাইসেন্স বাতিলও করে দেয় এখানকার পুলিশ স্টেশন।’
বর্তমানে কোন সমস্যা নেই বলে জানান আরিফ। আরিফ বলেন, এখন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ব্রডকাষ্ট পার্টনার গাজী টেলিভিশন। বিশ্বকাপের শুরু থেকে ভারতে রয়েছেন জিটিভির ভারপ্রাপ্ত স্পোর্টস ইনচার্জ তায়িব অনন্ত। হোটেল নিয়ে হয়রানির ওই ঘটনার পর থেকে তিনি অনেক বেশি হতাশ।
অনন্ত বলেন, ‘মুম্বাই এসে হোটেল নিয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার পর অনেক হতাশ হয়েছি, ভারতের অন্য কোথাও এই অভিজ্ঞতা হয়নি। এমনটা হবে কল্পনাও করিনি। তাছাড়া দেশের গণমাধ্যমে খবরটা প্রচার হওয়ার পর পরিবারের সবাই আমাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অনেক ফোন পেয়েছি, সবাই সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাচ্ছেন।’
ঘটনাটি জানার পর বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় ইংরেজি দৈনিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’র সিনিয়র সাংবাদিক হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া নিজ উদ্যোগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানোর পর মন্ত্রণালয় দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন, মুম্বাইয়ে উপ-হাইকমিশন এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এমন দুঃখজনক ঘটনা আর ঘটবে না বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়।
হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমার অনুমান, ওরা বাংলাদেশের মানুষকে পাকিস্তানের লোকদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। ভারতের কিছু অঞ্চলে সম্ভবত পাকিস্তানি নাগরিকদের হোটেলে রাখার ব্যাপারে আইনত কিছু বিধিনিষেধ আছে। আমার মনে হয়, ওই বিধিনিষেধগুলো ওরা বাংলাদেশীদের ওপরও খাটানোর চেষ্টা করছে।’
সাংবাদিকদের হয়রানির ঘটনাকে দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত উল্লেখ করে হুমায়ূন কবির বলেন, এটা কোনো শিষ্টাচারের অংশ হতে পারে না। ওই সাংবাদিকদের কাছে আইসিসির অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ছিলো। সেই অর্থে তারা ভারতে আইসিসির অতিথি হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তারপরও তাদের সঙ্গে এমন অপমানজনক আচরণ করা হলো। সাধারণ একজন বাংলাদেশী পর্যটকের সঙ্গেও এমনটা করার কোনো কারণ নেই বলে জানান তিনি।
হুমায়ূন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ আর ভারত সরকার সবসময় বলে আমাদের মাঝে গভীর সম্পর্ক, আমরা একে অপরের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’। কিন্তু এই ‘বন্ধুত্বের’ সম্পর্কটা তো এমন আচরণে প্রতিফলিত হয় না। ঘটনাটি খুবউ ন্যাক্কারজনক। এটি জনগণের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে একটি নেতিবাচক বার্তা দেয়।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে না হলেও ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলা হওয়ার কারণে মূলত মুম্বাইয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাংলাদেশীদেরও থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে মনে করেন এই সিনিয়র সাংবাদিক। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাতারে এভাবে ফেলাকে ‘খুবই আপত্তিকর’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের উচিৎ ছিলো ওই সমস্যায় পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, দিল্লিতে হাইকমিশন বা সরাসরি ঢাকায় যোগাযোগ করা। তখন হয়ত এতোটা হয়রানি হতো না।
তার মতে, বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ ভারত সরকারের সঙ্গে সরাসরি এ বিষয়ে কথা বলে স্পষ্ট করা যে, বাংলাদেশের নাগরিকদের ভারতে যাওয়া বা থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে সত্যিই কোনো বিধিনিষেধ আছে কিনা; নাকি এটা শুধুই হোটেল কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতা ও ভুল বোঝাবুঝির ফল। যেনো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কাউকেই আর এ ধরণের বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি শক্ত মেরুদণ্ডের রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সরকার, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক সম্প্রদায়ের একটা অংশে যথেষ্ট দেশপ্রেম এবং সাহসের অভাব আছে বলেই ভারত আমাদের ন্যায্য সম্মান দেয় না।’
অধ্যাপক আদনান ফাহাদের মতে, বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি আমাদের অতিমাত্রায় নতজানু হয়ে থাকার সুযোগও ভারত নিচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুরাষ্ট্র হওয়ার পরও এমন অপমানজনক আচরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক হবে সম্মানের, দাসত্ব বা আধিপত্যের নয়…।’