এটি অবশ্যই বলা যায় ব্রিটেনের ইতিহাসে ব্রেক্সিট ইস্যুটি একটি জায়গা করে থাকবে। সমসাময়িক কালে ব্রিটেন এতোটা সংকটে আগে কখনো পড়েনি। যতোটা ব্রেক্সিট নিয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির জটিলতা ও নানামাত্রিক বিবেচনায় দেশটির সমাজ ব্যবস্থায় মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন দেখতে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
ব্রেক্সিট চুক্তিকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়া যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি মুহুর্তে মুহুর্তে বদলে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত এই পরিবর্তন ব্রেক্সিট ইস্যুকে আরো জটিল করে তুলেছে।
একবারে শেষ রাউন্ডে খেলছেন প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। পার্লামেন্ট, মিডিয়া যেখানে যখন সুযোগ পেয়েছেন মে বলেছেন গণভোটের রায়কে মানতে হবে, নইলে এটি হবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণের রায়কে তাঁর মেনে নেয়াটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের নিয়ম। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নৈতিকতার দায়। আর এজন্যই সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের আবারো গণভোট আয়োজনের আহবানকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন টেরেসা মে এবং বলেছেন এর মাধ্যমে এক সময় যে পদের দায়িত্বে ছিলেন সেটিকে খাটো করেছেন ব্লেয়ার। নতুন করে গণভোট আয়োজন করা হলে তা জনগণের আস্থা নষ্ট করবে এবং ব্রিটেনের গণতন্ত্রের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না বলে সতর্ক করেছেন টেরেসা মে। রাজনৈতিক অখন্ডতার অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ভোট হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে, চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকরের কথা মাথায় রেখে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে সরকারের কেবিনেট। এজন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের জন্য দুই বিলিয়ন পাউন্ড স্টারলিং অনুমোদন দেয়া হয়েছে যাতে বিরুপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। এছাড়াও ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ থেকে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকরের কথা মাথায় রেখে পূর্ব প্রস্তুতির জন্য এক লাখ চল্লিশ হাজার কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেবে সরকার। এরকম একটি নীতিও গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে পার্লামেন্টের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন সময় ব্রেক্সিট চুক্তি বিষয়ে এটি পরিষ্কার হয়েছে। লেবার পার্টির সঙ্গে কার্যত পেরে উঠছে না ক্ষমতাসীনরা। এছাড়াও কনজারভেটিভ পার্টির অনেক সদস্য ব্রেক্সিট চুক্তির বিপক্ষে থাকায় বিশ্লেকরা মনে করছেন কেবিনেট নো-ডিল চুক্তির প্রস্তুতি নিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কাজ করতে চাইছেন।
এক. চুক্তি না হলে আরো জটিলতায় পড়বে ব্রিটেন এই ভয় দেখিয়ে জানুয়ারি মাসে ব্রেক্সিট চুক্তির পক্ষে ভোট আদায় করা। দুই. বিরোধী দলকে আগাম নির্বাচনের দাবি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।
নতুন করে যারা গণভোট আয়োজনের পক্ষে তারা সরকারের এই নীতি গ্রহণ করাকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।
তবে শেষ অঙ্ক দেখা এখনো বাকি। সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কী হতে যাচ্ছে বা ব্রেক্সিটের ভবিষ্যত কি? টেরেসা মে কিংবা সরকারের গতিপথও অজানা।
তবে, ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে খুব জরুরি কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। গণতন্ত্র ও অধিকার প্রশ্নে সঠিক শব্দটির গণতান্ত্রিক দিকের ব্যাখা জরুরি। সেই সঙ্গে দেখা প্রয়োজন গণতন্ত্র চর্চার সেফ গার্ড সবসময় কাজ করে কি-না? গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো কার্যকর প্রভাব ফেলে?
ভৌগোলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে কিনা? অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্বান্ত হলেই কি তা সর্বোত্তম?
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। হাউজ অব কমন্স এবং হাউস অব লর্ডস। হাউস অব কমন্সের সদস্য সংখ্যা ৬৫০। যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। সরাসরি জনগণের প্রতিনিধি। আর হাউস অব লর্ডসে সদস্য সংখ্যা হলো প্রায় ৮শর মতো। এই সদস্যরা মনোনীত হন একটি সিলেকশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দিয়ে।
প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে যুক্তরাজ্যের রাণী তাদের মনোনীত করেন। এছাড়াও রয়েছে একটি সিলেকশন কমিশন। এই কমিশনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় মনোনীতদের বাছাই-কার্যক্রম। বিভিন্ন পেশার মানুষের সমন্বয়ে এই হাউস অব লর্ডস গঠিত। সবাই নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত।
মনোনীত ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় স্কলার। কেউ হয়তো একাডেমিশিয়ান, কেউ হয়তো অর্থনীতিবিদ। আবার কেউবা প্রকৌশলী অথবা টেকনিক্যাল বিষয়ের ওপর দক্ষ-অভিজ্ঞ লোক।
একদিকে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিতরা যেমন আইন প্রণয়ন করেন, বিতর্ক করেন। আবার হাউস অব লর্ডসের পন্ডিত ব্যক্তিত্বরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ দেখে একেকটি বিষয়কে দেখেন। বিতর্ক করেন, সমালোচনা করেন, ভুল করার প্রবণতা দেখা দিলে তা শুধরিয়ে দেয়া তাদের কর্মপরিধির অন্তর্ভুক্ত।
এভাবেই পার্লামেন্টে উত্থাপিত কোন বিষয় আইনে পরিণত হওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে একটা বাচ-বিচারের সুযোগ তৈরি হয়। ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
তুলনামূলক ভালো সিদ্ধান্ত আসে। সবচেয়ে বড় কথা জনগণের কাছে জবাবদিহির জায়গাটা পোক্ত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পার্লামেন্টারি কমিটিতো রয়েছেই। কমিটিগুলো খুবই ক্ষমতাশালী।
প্রয়োজনে সরকারের প্রধানমন্ত্রীকেও জবাবদিহি করতে হয় এই কমিটিতে। দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্র চর্চার সেফ গার্ড হিসেবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপেক্ষাকৃত ভারসাম্যপূর্ণ।
ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড অঞ্চলগুলো নিয়ে গঠিত দেশ যুক্তরাজ্য। প্রত্যেকটি ভূ-খন্ডের নিজস্ব ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রয়েছে। একেক ভূ-খন্ডের মানুষের চাহিদার মধ্যেও ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। তাই তো ২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে অঞ্চলভিত্তিক ভোটের ফলাফলে পার্থক্য দেখা যায়। নাগরিকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।
অঞ্চল ভেদে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে কিছু বিষয়ে মত ভিন্নতা থাকতেই পারে। তা স্বীকার করে নিলেও ব্রিটেনের মতো একটি উন্নত রাষ্ট্রে ভারসাম্যপূর্ণ পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা বহাল থাকতেও ব্রেক্সিট ইস্যুকে জটিলতার হাত থেকে কেন রেহাই দিতে পারলো না, সে প্রশ্ন আবশ্যিকভাবে এসে যায়। ধরে নিলাম অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ব্রেক্সিট ইস্যুকে উস্কে দিয়েছে। তাহলে ব্রিটিশ নাগরিকেরা শুধুই কি আবেগ তাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন? এই মুহুর্তে জনগণের মত পাল্টানোর নিয়ামকসমূহ কি? তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনরায় কি কখনো ভুলও হতে পারে? তবে,গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফাঁকিতে নেতৃত্বের কমিটমেন্ট, গুণাবলী সংকট অথবা জনকল্যাণে নেতৃত্বের সর্বোত্তম পন্থা বেছে নেয়ার অভাব রয়েছে কি?সদিচ্ছা, বিচক্ষণতা কিংবা চেষ্টার খামতি থাকলে সেটাও বিবেচ্য। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ তো রয়েছেই। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চিন্তার খোরাক রয়েছে বিস্তর।
ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্রিটেনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। দেশটির অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতির ক্ষমতা বলয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ডুবে গেছে ব্রিটেন। ব্রেক্সিট সঙ্কট নিরসনে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশটিকে।
সরকার কিংবা পার্লামেন্ট কেউই দিতে পারছে না সঠিক সমাধান। অথচ ব্রেক্সিট ইস্যু কোন সাধারণ বিষয় নয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে ব্রিটেনের ভবিষ্যত।
ইইউ ত্যাগ করে একলা চলো নীতিতে ফেরা ব্রিটেনের জন্য কতটা সহজ বা দ্রুত মানিয়ে নেয়ার মতো তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা প্রয়োজন। তেমনিভাবে ইইউর সঙ্গে থেকে গেলে প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন হবে বা আদৌ ব্রিটেনের জন্য ভালো কিংবা স্বস্তিদায়ক হবে কি-না তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ জরুরি। সেই সঙ্গে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়াও আবশ্যক।
নইলে দিন দিন এই সঙ্কট বাড়বে বৈ কমবে না।সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসা ফল্ট লাইন দেশটির মানোযোগ ঘুরিয়ে দিতে পারে অন্য দিকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)