বিশ্বের যেসব ক্রিকেটার ক্রীড়া নৈপূণ্যের পাশাপাশি বিনয় এবং সততা দিয়ে ক্রিকেটকে সৌন্দর্যময় করতে বড় ভূমিকা রেখেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলার কোর্টনি এন্ড্রু ওয়ালশ তাদেরই একজন। এদেশের আপামর ক্রিকেটমোদীদের কাছে কোর্টনি এন্ডু ওয়ালশ বরাবরই ভীষণরকম প্রিয় এক নাম। সেই ওয়ালশই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বোলিং কোচ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আসছেন। বাংলাদেশের মাটিতে তার পা রাখা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ওয়ালশ যখন মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন তখন এমন কল্পনা বোধ হয় কোনো বাংলাদেশির মাথায় ঢুকেছিল বলে মনে হয় না-যে একদিন ওয়ালশ-এর মতো গ্রেট এ দেশে খেলা শেখাতে আসবেন। কারণ প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ওয়ালশ-এ যুগে আমাদের অবস্থান ছিল প্রায় দর্শকের মতো। কিন্তু গত এক দশকে আমাদের তরতর করে এগিয়ে যাওয়া ক্রিকেট অনেক অসাধ্যই সাধন করেছে। অনেক স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে তাই আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই।
ওয়ালশের আগমনে আমাদের সময়ের কিশোর-তরুণরা ভীষণরকম উৎফুল্ল না হয়ে পারছে না। কারণ আমাদের তরুণ বেলায় ওয়ালশ ছিলেন স্বপ্নের এক বোলার। বাংলাদেশ যখন ওয়ান ডে আর টেস্ট মর্যাদা পায়নি, তখনতো পাকিস্তান আর ভারতের ঠেলাঠেলির মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজই ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেট দল। আর প্রিয়দের তালিকায় ছিল ভিভ রিচার্ডস, ডেসমন্ড হেইন্স থেকে শুরু করে ম্যালকম মার্শাল, এমব্রোস, কোর্টনি এন্ডু ওয়ালশ, রিচি রিচার্ডসন, ব্রায়ান লারা। থ্রিব্যান্ড রেডিওতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার ধারাভাষ্য শোনার জন্যেও সেসময় লাইন পড়ে যেতো।
ওয়ালশ আসছেন এ সংবাদ তাই সর্বত্র উত্তেজনার ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই অনেক ভাবে উত্তেজনা প্রকাশ করছেন। ওয়ালশ আসার খবরে কবি-লেখক শামীম আহমেদ জিতু তার ফেসুবক ওয়ালে উত্তেজনা প্রকাশ করেছেন এভাবে-‘বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের বোলিং কোচ হচ্ছেন কোর্টনি ওয়ালশ। খোদার কসম আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাইতেছে শুধু এই খবরটা শুনে। শুধু শামীম বলে কথা নয়, ক্রীড়াভক্তদের আড্ডায়-আলাপে ওয়ালশ এখন শীর্ষে অবস্থান করছেন। ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের সিডার (বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন) অফিসে একদল ক্রীড়াভক্তের প্রতিসন্ধ্যায় জমপেশ আড্ডা বসে।
রাত জেগে খেলা দেখা আর খেলা নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করা আড্ডার মানুষগুলোর প্রিয় অনুষঙ্গ। অনেকেই ভাত খাওয়ার চেয়ে রাতে খেলা দেখাটাকেই জীবনের জরুরি কাজ বলে মনে করেন। সেই আড্ডার মূল পৃষ্ঠপোষক সংস্থাটির নির্বাহী প্রধান শফিকুল আলম লিটনের মতে, গর্ডন গ্রিনিজের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ওয়ালশ-এর মতো সেই দুর্ধর্ষ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের আগমন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরও এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ। ওয়ালশ মানুষটিইতো অন্যরকম। মাঠে শুধু নৈপূণ্য নয়, তার বিনয় আর ভদ্রতার গল্পের রঙতো আমাদের প্রজন্মের কাছে এখনও ভীষণ উজ্জ্বল। সেই রঙ আরও ছড়িয়ে পড়বে।
কোর্টনি ওয়ালশ টানা ১৭ বছর ক্রিকেট মাঠে ছিলেন। ৮৪ থেকে খেলেছেন ২০০১ সাল পর্যন্ত। বিদায়ক্ষণে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটি তার দখলেই ছিল। ১৩২টি টেস্ট আর ২০৫ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন তিনি। টেস্টে ৫১৯টি উইকেট আর ওয়ানডেতে ২২৭টি উইকেট নেন তিনি। তবে কোচ হিসেবে তার ক্যারিয়ার খুব একটা সুদৃঢ় নয়। সে বিষয়ে অবশ্য ব্যাখা দিয়েছেন বিসিবির সভাপতি। কোচিং ক্যারিয়ারের বাইরে অন্যসব অনুষঙ্গকে প্রায়োরিটি দিয়েই তাকে আনা হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে বলা যায়, আমাদের ক্রিকেটের জন্যে তিনি অবশ্যই আর্শীবাদই হবে। কেননা, ওয়ালশ-এর মুখ থেকে সেই নিষ্পাপ হাসি এখনও মিলিয়ে যায়নি।
কোর্টনি ওয়ালশ-এর আগমনের খবরে দেশের ক্রীড়ামোদীরা যখন ভীষণরকম উত্তেজিত ঠিক তখনই বাংলাদেশ ফুটবল দলের মালদ্বীপের কাছে ০-৫ গোলে হার ফুটবলে আরেকদফা কালিমা লেপন করেছে বললে ভুল হবে না। ১ সেপ্টেম্বর ফিফার অনুমোদনে এই প্রীতিম্যাচের আয়োজনটি ছিল মালদ্বীপের রাজধানীতে। বাংলাদেশের নতুন ফুটবল কোচ বেলজিয়ামের টম সেন্টফিটের কোচিং-এ প্রথম ম্যাচ ছিল এটি। যাওয়ার আগে বলেছিলেন টিম ড্র করলেই নতুন চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হবেন। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলাররা যে তাকে এতোটা ছ্যাঁকা দেবেন তা হয়ত এই কোচ স্বপ্নেও ভাবেননি। মালদ্বীপের কাছে হারাটা নতুন কিছু নয়। অনেকদিন ধরে বাংলাদেশ এই দলটির কাছে হারছে আর হারছে। অথচ ৮৫ সালে এই মালদ্বীপকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এটি ৩১ বছর আগের কথা। তখন বাংলাদেশ মালদ্বীপকে নিয়ে মাঠে ছেলে খেলা করতো । কিন্তু নিয়মিতর কী নির্মম পরিহাস- সেই মালদ্বীপই এখন বাংলাদেশকে নিয়ে ছেলে খেলা করছে।
অথচ সবকিছুতেই এই দেশটি বলা যায় আমাদের থেকে পিছিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই দেশটিতে মাত্র ৪ লক্ষ মানুষের বসবাস। যা আমাদের যে কোনো জেলার জনসংখ্যা থেকেও কম। আসলে পরিসংখ্যান যাচাই করলে দেখা যায়, গত দেড় দশকে মালদ্বীপের ফুটবল যেভাবে এগিয়েছে ঠিক সেভাবেই পিছিয়েছে আমাদের ফুটবল। ২০০৮ সালে মালদ্বীপ সাফ গেমস জয়ের পর থেকে যেনো আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে। দক্ষিণ এশিয়ার কাউকেই তারা আর পাত্তা দিতে নারাজ। অন্যদিকে বাংলাদেশের ফুটবল এতোটাই নিচুতে নেমে যাচ্ছে যে এই খেলাটি নিয়ে ক্রীড়ামোদীরা একদম আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলাফল আনতে না পারার কারণে নতুন প্রজন্মও দেশের ফুটবল নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়।
বাংলাদেশের এই ফুটবল দুরবস্থা নিয়ে আসলে কিছু বলাও অনর্থক। তবে এক বাক্যে বললে বলতে হয়, গত ২৫ বছরে আমাদের ক্রিকেট যেমন প্রতিটি সময়কে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে, অন্যদিকে ফুটবলের ২৫টি বছর অপচয় হয়েছে। যে পরিকল্পনা, যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল ২৫ বছর আগে, ফুটবলে সেই পরিকল্পনা আর উদ্যোগের কথা এখন বলা হয়। ফুটবলে যে সীমাহীন ব্যর্থতা, এর জন্যে পুরোটাই দায়ী বাফুফের কর্তা ব্যক্তিরা। বছরের পর বছর ধরে তারা একইভাবে চলে, একই কথা বলে। তাদের পরিকল্পনার অভাব, কোচ নিয়োগে দুরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারা, জাতীয় দলকে ঢেলে সাজাতে না পারা-এসব কারণেই ফুটবলে বর্তমান দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। খুব সঙ্গত প্রশ্ন-ফুটবলে যদি মালদ্বীপের মতো দেশ এগিয়ে যেতে পারে তাহলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারল না কেন?
একসময়তো মালদ্বীপের চেয়ে বাংলাদেশের ফুটবল অনেক অনেক এগিয়ে ছিল। কার্যত এসবের কোনো জবাবদিহিতা যেমন নেই, তেমনি ভালো গবেষণাও নেই। প্রতিদিনই আমরা হারছি, আর বলছি সামনে এরকম হবে না। নিশ্চয় এবারও বাফুফের কর্মকর্তারা একই স্টেটমেন্ট দেবেন। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলবেন। আর সবকিছু কোচ বেচারার উপর চাপিয়ে দেবেন। কিন্তু লজ্জা পেয়ে কেউ পদ ছাড়বেন বলে মনে হয় না। আসলে কোচ কী আর করবেন? ফুটবলে ঘূণতো আর আজ ধরেনি। অনেক আগেই ধরেছে। এখন শুধু ভেঙে পড়ছে।
ফুটবলের মূল সংকট অবশ্যই কর্মকর্তারা, মোটেও ফুটবলাররা নয়। দেশের একই পরিবেশে থেকে ক্রিকেটাররা বিশ্ব মাতিয়ে ফেলার সক্ষমতা দেখালেও কেন ফুটবলে সেটা সম্ভব হচ্ছে না?
ফুটবলকে এগিয়ে নিতে হলে ৩৪ বছরের ফুটবল ইতিহাস পোর্স্টমটেম করা প্রয়োজন। এরপর আত্মমূল্যায়ন করে দীর্ঘমেয়াদী (কমপক্ষে ৫ বছর) পরিকল্পনা করতে হবে। একথা বোধ হয় বাফুফের সভাপতিসহ কারোরই অজানা থাকার কথা নয় যে, হঠাৎ করে ফুটবলে ভালো ফলাফল করার কোনো বিন্দ্রমাত্র সুযোগ নেই। ফুটবলে এখন যে ধারায় চলমান তাতে করে মনে হচ্ছে অচিরেই ভুটানের কাছে আমাদেরকে ওই একই কায়দায় ধরাশয়ী হতে হবে। কেননা ভুটানও আমাদের দুর্বলতার সুযোগে এখন বেশ এগিয়ে গেছে।
সিডারের আড্ডায় একজন হেসে বলছিলেন, মুমূর্ষু, অনুজ্জ্বল ফুটবল নিয়ে যত কথাই বলেন কাজ হবে না। এদেশে স্বর্ণালী দিনের স্মৃতি (২৫ বছর আগে-আশির দশক পর্যন্ত) রোমন্থন করে বেঁচে আছে বাম রাজনীতিক, সিনেমা পরিচালক আর ফুটবলাররা। উনারা যা কিছু করেছিলেন তা আর পরের কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। এই তিনটি ধারা সাদাকালোই থেকে গেল, রঙিন আর হতে পারলো না। ক্রিকেটাররাই কেবল সেটা করতে পেরেছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)