জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তার মিয়ানমার সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির সরকার।
তিনি বলেন, এই স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাই ইঙ্গিত দেয় যে, রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ কিছু ঘটছে। বুধবার এক ঘোষণায় লি নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানান।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করেই জানিয়েছে যে তারা তাকে আর সহায়তা করবে না উল্লেখ করে লি বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে তিনি ‘বিভ্রান্ত ও হতাশ’।
‘এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে যে রাখাইনে নিশ্চয়ই ভয়াবহ রকমের শোচনীয় কোনো ঘটনা ঘটছে,’ বলেন তিনি।
আগামী মাসে ইয়াংহি লি’র মিয়ানমার যাওয়ার কথা ছিল। ওই সফরের সময় রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মিয়ানমারের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার কথা ছিল।
বিবিসি জানায়, লি সর্বশেষ মিয়ানমার গিয়েছিলেন গত জুলাইয়ে। এর পরই আগস্টের ২৫-এ ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা ব্যাপক সংখ্যায় পালাতে থাকে।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকেও জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বিবিসিকে বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের জন্য মিয়ানমারের উর্ধ্বতন সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা যেতে পারে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সহায়তা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্তিয়েরস – এমএসএফ) এক জরিপ শেষে জানিয়েছে, গত ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর সময়টার মধ্যে অন্তত ৯ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তবে একেবারে কাটছাঁট করা হিসেবেও সংখ্যাটি ৬ হাজার ৭শ’র কম নয়, বরং বেশি। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ৭৩০ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে জাতিসংঘের হিসেব মতে, রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনী ও সরকার সমর্থিত বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে একে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধন কর্মসূচি’ বলে বর্ণনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।