মহাভারতের একটি চরিত্রের নাম একলব্য। সেই একলব্যকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ‘একলব্য’ উপন্যাসের কাহিনী। তবে মহাভারতের মতো বিশাল কাহিনী থেকে একটি চরিত্রকে তুলে এনে সেটার সঙ্গে আধুনিক জীবনধারাকে মিশিয়ে সাধারণ কিছু মানুষ যারা লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত তাদের জীবনকে তুলে ধরা খুব সহজ ছিলো না নিশ্চয়ই। সেসব কথাই জানালেন এবারের বইমেলায় প্রকাশিত ‘একলব্য’ উপন্যাসের লেখক হরিশংকর জলদাস।
বললেন, এই বইটি লিখতে গিয়ে পরিশ্রম হয়েছে খুব। কাজও করতে হয়েছে প্রচুর। সঙ্গে পড়াশোনাতো ছিলোই। রাতের পর রাত জেগে আছি। পাশেই হয়তো স্ত্রী ঘুমাচ্ছে আর আমি পড়াশোনা করছি। বলা যায় দীর্ঘ দশ বছরের পরিশ্রম আজকের এই বই।
একটা লেখার সঙ্গে অনেক শ্রম, অনেক ভালোবাসা আর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। হরিশংকর জলদাস বললেন, এসবই পরিপূর্ণ হয় যদি পাঠকের কাছে সেটা সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে। পাঠক যদি লেখা পড়ে তৃপ্তি না পায় তাহলে সেই লেখার মূল্য কি?
এর আগে আরো অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এবারই প্রথম প্রকাশনা উৎসব হলো। লেখক বলেন: অবশ্যই সেই অনুভূতিটা ভিন্নরকম। এবারের আয়োজনে আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, আসাদুজ্জামান নূর, পূরবী বসু, শামসুজ্জামান খান। সবার উপস্থিতিতেই আয়োজনটা ছিলো অনেকটাই ভিন্নরকম।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
হরিশংকর জলদাস উঠে এসেছেন একটি প্রন্তিক জনগোষ্ঠী থেকে। তার লেখাতে তাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে প্রান্তিক জনগণের কথাই। এরকম একটি উপন্যাস ‘রামগোলাম’। এছাড়া উচ্চবিত্তের কিছু কথাও উঠে এসেছে ‘এখন তুমি কেমন আছ’ এবং ‘হৃদয়নদী’ উপন্যাসের মধ্যে। একেবারেই গৃহিনীদের নিয়ে রয়েছে তার লেখা। লেখা আছে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীকে নিয়েও।
লেখক জানালেন তিনি মূলতঃ লিখেন নিজে তৃপ্তি পাওয়ার জন্য এবং পাঠককে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য। বলেন, আপনার যদি পাঁচটি সন্তান থাকে তাহলে পাঁচটিই আপনার সমান প্রিয়, সেখানে কেউ বেশি বা কেউ কম, সেই সুযোগ নেই। ঠিক তেমনই আমার বইগুলোও।
‘শুধু বলতে পারি কিছু বই লিখে আমি তৃপ্তি পেয়েছি। মানে বইগুলো লিখে আমার মন ভরেছে। তবুও পুরোপুরি নয়। পুরোপুরি তৃপ্তি পেলে কিন্তু সৃষ্টিটা ওখানেই থেমে যাবে। একলব্য, আমি মৃণালিনী নই, রামগোলাম লিখে আমি তৃপ্তি পেয়েছি।’
প্রান্তিক জীবন এবং কখনো কখনো ভিন্নধর্মী কিছু বিষয় নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে গেলেও এই লেখকের স্বপ্ন রামায়ন রচয়িতা কৃত্তিবাসকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার। পাশাপাশি এমন একটি লেখা লিখতে চান যেখানে একেবারে খোলা চোখে এবং সাদা চোখে জীবনকে দেখানো হবে।
শুধু নিজে লিখেই তৃপ্তি চান না, তৃপ্তি দিতে চান পাঠককেও। বলেন, আমি চাই পাঠক আমার বই পড়ুক। পড়ে তৃপ্তি পাক। বই কিনে বাড়ি ফেরার পর যেনো পাঠক প্রথমে লেখককে এবং পরে প্রকাশককে গালাগালি না দেয় যে, এত রংঢং দিয়ে কি বই বের করলো, পড়ে শান্তি মিললো না! টাকাটা পুরোই জলে গেলো, এমন ভাবনা যেন পাঠকের মনে না জন্মায়।
পাঠকের মনে আনন্দ ছড়ানোর উদ্দেশ্যেই লেখোলেখি করেন হরিশংকর জলদাস। সেটাকেই কাজের সফলতা বলে মনে করেন তিনি। বলেন, পাঠক জনস্রোতের মতো এসে আমার বই পড়ে না। কিন্তু যারা আমার লেখা পছন্দ করে তারা খুঁজে খুঁজে আমার বই পড়ে। তারা নিজেরাই জানতে চায় আমার কোনো বই বেরিয়েছে কিনা। সেজন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমি যে যেন তেন ভাবে লিখিনা সেটা তারাই আমাকে উপলব্ধি করায়।
প্রান্তিক এক জেলে পরিবার থেকে উঠে এসেছেন হরিশংকর জলদাস। বাংলা সাহিত্য জগতে উজ্জ্বলভাবে লিখিয়েছেন নিজের নাম। তবে শুধু তিনি একা উঠে আসলে হবে না। এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য শিক্ষার হার আরো বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন এই লেখক। বলেন, ওরা ওদের নৌকা হারিয়েছে, জাল হারিয়েছে। এখন ওদের উঠে আসার একটিই পথ, সেটা হলো শিক্ষা। সেখান থেকে উঠে আসতে হবে অসংখ্য হরিশংকর জলদাসকে। তাহলেই সম্ভব এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়ন।
দেশের বাইরের অনেক সাহিত্য এদেশের মানুষ পড়তে পেরেছেন। এখন পড়ছেন আরো বেশি মানুষ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সম্ভারও কম না হলেও দেশের বাইরে, বাংলার বাইরে তেমন পরিচিতি নেই। এই সাহিত্যকে বিশ্বজুড়ে পাঠক সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই। এবারের বইমেলা উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেকথা বলেছেন।
হরিশংকর জলদাসের মতে, যেসব বই আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে আরো উজ্জ্বল করেছে সেগুলো ব্যক্তিপর্যায়ে হোক বা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সেসব অনুবাদ করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র তাহলেই দেশের সাহিত্য ছড়িয়ে যাবে দেশের বাইরে।
এবছরের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় হরিশংকর জলদাসের এপিকধর্মী উপন্যাস ‘একলব্যে’র প্রকাশক অন্যপ্রকাশ। বইটির দাম ৩৩৮ টাকা।