গত সপ্তাহে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। ডিএসই’র সূচক সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করেছে। শেয়ারবাজারেরে উর্ধমূখী সূচক দেখে বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকই ‘ঘরপোড়া গরু’র মতো ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, বাজার প্রভাবিত করে ছোট ছোট বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করার আরেকটা ফাঁদ পাতা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের আশ্বস্ত করতে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ডিএসই পরিচালনা পর্ষদ। ডিএসইর নেতারা বলেন, ‘সরকার, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ডিএসইসহ বিভিন্ন মহলের নানা উদ্যোগের ফলে অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজার ভালো একটি জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, ধস-পরবর্তী পাঁচ-ছয় বছরে দেশের অর্থনীতি ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এ সময় শেয়ারদর ও সূচক কমছিল। বাজারের সূচক ও লেনদেন বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ডিএসই পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক, ফাইন্যান্স, জ্বালানি খাতসহ বড় বড় পরিশোধিত মূলধনের শেয়ার যখন মুভ করে তখন সূচকে প্রভাব পড়ে। যে সূচকগুলো নিচে পড়ে ছিল সে সূচকগুলোতে রাতারাতি প্রভাব পড়েছে বলে ‘তরতর’ করে সূচক বেড়েছে। তবে মূল্যস্তর বিবেচনা করলে, সার্বিকভাবে বাজারে বড় কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে— এমনটি বলা যাবে না। এ বাজার নিয়ে এখনই ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘২০০৯-১০ সালের শেষের দিকেও ব্যাংকের শেয়ারের দাম যখন বেড়েছিল তখন সূচকে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। সেই হিসাবে এখনকার পুঁজিবাজারে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, চিন্তার কিছু নেই। এখন যে পর্যায়ে সূচক আছে, এটাতে ভয়ের কিছু নেই।’ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইর সূচক সর্বকালের শীর্ষে উন্নীত হয়। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর ওই সময়ের প্রধান সূচক ডিজিইএন ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট। তিন মাসেরও কম সময়ে ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তা ৫ হাজার ২০৩ পয়েন্টে নেমে আসে। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে এ সূচক সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৬১৬ পয়েন্টে নামে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক এ ক্ষতের পরিমাণ ২০১২ সালের অক্টোবর সময়ের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২২ শতাংশ বা ২৭ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ের মুদ্রা বিনিময় হারের (প্রতি ডলার ৮১ টাকা) হিসাবে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। ২০১০ সালের ধসের পর বাজার মূলধন কমে যাওয়া এবং দেউলিয়াত্ব, মানুষের পুঁজি ও কাজ হারানোর ফলে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতের হিসাবটি করেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এডিবি। গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত এডিবির এক প্রতিবেদনে শেয়ারবাজারে ধসের কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়, মার্জিন ঋণে শিথিলতা ও অতিরিক্ত নির্ভরতা, মানসম্মত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং না থাকা এবং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দুর্বলতাকে। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারের ধস সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মীমাংসা না হওয়াকেও এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখেছে সংস্থাটি। ডিএসই নেতারা বলেছেন, একপর্যায়ে দীর্ঘদিন বাজার অবমূল্যায়িত ছিল। কিন্তু, তারল্যপ্রবাহ, মানুষের হতাশা ইত্যাদি নানা কারণে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ব্যাংকে আমানত রাখার চেয়ে সে ব্যাংকের অবমূল্যায়িত শেয়ারে বিনিয়োগ করে বার্ষিক লভ্যাংশ নেয়াটাই বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে। এর মাঝেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের বেশকিছু কাঠামোগত সংস্কার করে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেয়ারে ব্যাংকের এক্সপোজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও একটি গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়। এদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও দেখলেন, বাংলাদেশের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সম্ভাবনার মধ্যেই শেয়ারবাজার অনেক অবমূল্যায়িত হয়ে আছে। ২০১৬ সালে তারা এ বাজারে কয়েক গুণ বিনিয়োগ করেন। বিষয়টি স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতেও ভূমিকা রেখেছে। ডিএসই পরিচালনা পর্ষদ আশা করছে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি কর্মসূচির সুবাদে আগামী দিনগুলোতে অনেক শিক্ষিত ও সচেতন বিনিয়োগকারী উঠে আসবে।যাদের মাধ্যমে একটি টেকসই ও উন্নত মানের পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে উঠবে। সেজন্য বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা ও বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষের নিয়মনীতি পালনের সুপারিশ করেছেন তারা। শেয়ারবাজার বিশ্লেষকদের মতে, এখানে বিনিয়োগ অনেকটা নেশার মতো। নেশায় না পড়তে সতর্ক করেছেন তারা। চিন্তাভাবনা ও হিসাবনিকাশ করে বিনিয়োগ করার সুপারিশ তাদের। ঝুঁকিপূর্ণ এ বাজারের ঝুঁকি কমাতে হলে বাজারটা বুঝতে হবে। বার বার সতর্ক করে বলা হচ্ছে, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগটাই ঝুঁকিপূর্ণ। বিনিয়োগ করার আগে নির্দিষ্ট কোম্পানির পারফরম্যান্স পরর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোম্পানি কী ব্যবসা করে, তার আয় কেমন, গত পাঁচ বছর কী লভ্যাংশ দিয়েছে—এসব সম্পর্কে জানতে হবে।’ শেয়ার বাজারের নেতাদের পরামর্শ হচ্ছে, ‘কেবল তারাই বাজারে আসুন যাঁদের উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে। তা-ও আবার উদ্বৃত্ত অর্থের পুরোটা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন না। একজন বিনিয়োগকারীর উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টাকা থাকলে সেখান থেকে তার উচিত হবে বড়জোর ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা। কারণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ও প্রতিটি শেয়ারের অপর নাম ঝুঁকি।’ পুঁজিবাজারে যদি সব সময় লাভ হতো তাহলে পৃথিবীতে আর কোনো ব্যবসা থাকত না।