বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নাকি নষ্ট করছে সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ। মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে হুড়মুড়িয়ে কিংবা বলা যায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য। তা হলে মানুষ কি করবে? কোথায় টাকা রাখবে? নিম্ন মধ্যবিত্তের একজন মানুষ বেতনের টাকা থেকে প্রতিমাসে কিছু কিছু সঞ্চয় করে একসময় এক লাখ টাকা হলে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য ছুটছে। মাস গেলে সে যদি নারী হয় তা হলে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনে পাবেন ৯১২ টাকা। আর যদি পুরুষ হয় তা হলে তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র কিনে পাবেন ৮৭৪ টাকা। এভাবে অল্প অল্প সঞ্চয় ভবিষ্যতে তাদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বা বিয়েশাদীতে কিছুটা হলেও উপকারে আসবে।
মানুষকে সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সরকার নানা সময় ক্যাম্পেইন করে। সেই সঞ্চয়ের প্রতি মানুষকে বিমুখ করার জন্য কিছুদিন পর পর বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রণালয়কে বলে, যেন সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হয়। কী তামাশা!
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছে সুদ কমানোর জন্য, পত্রিকাপাঠ করে জানতে পারলাম। ব্যাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বিগ্ন, কারণ সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশকে প্রশ্ন করা কি খুব অন্যায় হবে, যে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত না দেওয়া হয় তখন সেটার দায়ভার কেন নিম্নবিত্তের ওপর গিয়ে পড়ে? যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে, তখন কি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না আমাদের অর্থনীতিতে? ব্যাংক খাতকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জনগণের পকেট কেটে ভ্যাট নেওয়া হয় তখন সেটা কোন শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে? পক্ষান্তরে কি এটাই বলা যায় না, জনগণের টাকায় ব্যাংকে বাঁচিয়ে রাখার নাম করে পরোক্ষভাবে চোর-বাটপারদের চুরি করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে?
আমরা অবশ্যই মানি এবং বুঝি, ব্যাংকের সুদের চাইতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ার সেটার ঘাটতি সরকারের ওপর পড়ে। কোনো সন্দেহ নাই তাতে। কিন্তু ব্যাংকের সুদের পরিমাণ কেন কমাতে হচ্ছে? সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। কারণ মানুষের আস্থা নেই ব্যাংকের ওপর। মানুষের আস্থা নেই শেয়ার বাজারের ওপর। তাই বাধ্য হয়ে কষ্টার্জিত অর্থ ওই সঞ্চয়পত্র অফিসে গিয়ে দিয়ে আসে। মাস গেলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে তাতে। কেউ মেরে খাবে না। বা শেয়ারবাজারের মত এখানে ঢুকে চোরবাটপারেরা এখানে খেলতে পারবে না। এখন ব্যাংক খাতকে চুরি করার উৎসাহ দিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেয়া মানে মানুষ যাতে আবার ব্যাংকে টাকা জমান, এই তো?
পত্রিকায় জানা গেল, আগামী ২৬ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে ‘সরকারের আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেই বৈঠকে যাতে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী পদক্ষেপ নেন সে জন্য ওই চিঠিটা পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো প্রস্তাব করে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই পড়েছিলেন। কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদ ও মন্ত্রী বেশ সোচ্চার হয়েছিলেন তখন। যেন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো না হয়। পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন অর্থমন্ত্রী। কারণ একাদশ সংসদ নির্বাচন। জনগণের ভোট লাগবে আওয়ামী সরকারের।
সেই ভোট যারা নষ্ট করতে চায় তারাই আজ ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে, এটা যদি বলা হয়, তা হলে কি পুরোপুরি ভুল বলা হবে? যে কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পায়তারা চলছে। সিটি করপোরেশনের গৃহ কর ৯ গুণ বাড়নোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। সেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করে বলেছেন, এত গুণ বাড়ানো ঠিক হবে না। সামনে নির্বাচন। তা হলে হঠাৎ কেন এই সঞ্চয়পত্রের ওপর পেরেক বসানোর পায়তারা? যেখানে বাজেট পাশের আগে বলা হয়েছে আগামী দুবছর ভ্যাট, ব্যাংকের কর কাটা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ বর্তমানে যা আছে তাই থাকবে, সেখানে নতুন করে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর চেষ্টার মানে কী? দেখা যাক, আমাদের অর্থমন্ত্রী কী বলেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)