বৈশ্বিক করোনার ছোবলে গেল ২২ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে টিভি নাটকের শুটিং। এ অচলাবস্থার অবস্থার দেড়মাস পার হলেও অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়নি, বরং দিনে দিনে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। করোনা কারণেই ছোটপর্দার অভিনয় শিল্পী, পরিচালক ও কলাকুশলীরা এখন ঘরবন্দি। এদিকে আর দুসপ্তাহ পরেই ঈদুল ফিতর।
ঈদকে ঘিরে প্রতিবছর জমজমাট থাকতো উত্তরাসহ ঢাকার বেশিরভাগ শুটিং বাড়ি। শিল্পীদের সিডিউল নিয়ে চলতো রীতিমত কাড়াকাড়ি! কিন্তু এবার সব ব্যতিক্রম। শুটিং বাড়ির চেনা পরিবেশ অচেনা হয়েছে করোনার কারণে।
আসছে ঈদ অনুষ্ঠানমালায় টেলিভিশনে নতুন কী প্রচার হবে সেটাই এখন মূল চিন্তা টেলিভিশন কর্মকর্তাদের। অনেকেই করছেন বিকল্প পরিকল্পনা। অনেক চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নাটকের চেয়ে প্রোগ্রামের দিকে জোর দিচ্ছেন বেশি। পরিকল্পনা করছেন আলোচিত পুরোনো নাটক প্রচারের। তবে এসবে কিছুতেই করোনাকালীন ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
করোনার কারণে দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, কলাকুশলী, অভিনয়শিল্পী, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। এ কারণে সামনে খুব খারাপ সময় আসছে বলে ধারণা করছেন অনেকে। ছোটপর্দা শাসন করা কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, করোনার কারণে ক্ষতি প্রায় কয়েকশো কোটি টাকা! নাটক নির্মাণ থেকে শুরু করে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া অবধি ঈদের নাটকের বেশ কিছু কর্মযজ্ঞ থাকে। এরমধ্যে নাটক নির্মাণ, নানা মাধ্যমে নেই নাটকের প্রমোশন, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বাজেটসহ যাবতীয় কিছু রয়েছে। করোনার কারণে সবকিছুই হচ্ছে বাধাগ্রস্ত।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি ছাড়াও বিনোদনপ্রধান টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ২০ টি। আছে চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, একুশে টেলিভিশন, এনটিভি, আরটিভি, বৈশাখী, বাংলাভিশন, দেশ টিভি, মাই টিভি, মোহনা, মাছরাঙ্গা, চ্যানেল নাইন, জিটিভি, এশিয়ান টিভি, এসএ টিভি, বিজয় টিভি, দীপ্ত টিভি, বাংলা টিভি, নাগরিক টিভি, আনন্দ টিভি ও শিশুতোষ চ্যানেল দুরন্ত টেলিভিশন।
ঈদ আসলে প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলই ৫-১০ দিনের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। এসব অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকে নাটক বা টেলিফিল্ম। বেশকিছু ইনডোর অনুষ্ঠানও নির্মাণ করে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। এসব অনুষ্ঠানেও হাজির হন টেলিভিশন তারকারাই। কিন্তু তারকারা ঘরবন্দী থাকায় এবার সেই সুযোগ এবার থাকছে না বললেই চলে।
চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপে নাটকের পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টর গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন: ঈদ টার্গেট করে শুধু চ্যানেলে প্রচারের জন্য নির্মাণ হয় প্রায় হাজার খানেক নাটক। অনেক সময় এতো নাটক প্রচার হয় না।
তিনি বলেন: ঈদকে ঘিরে যে নাটকগুলো নির্মিত হয় তার বাজেট বছরের অন্য সময় নির্মিত নাটকের চেয়ে বেশি থাকে। তিন লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা অবধি বাজেট হয়। অ্যাভারেজে তিন লাখ টাকা করে ব্যয় হলেও ১ হাজার নাটকের শুধু নির্মাণ ব্যয় প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা। এছাড়া ইউটিউব ও ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটের জন্য এখন নতুন নতুন কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে শুধু নির্মাণেই ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয় প্রত্যেক ঈদে। শুধু নাটক বানালেই হয় না, এটার সঙ্গে প্রমোশন করতে হয়। এখানে একটা বড় বাজেট লাগে। সবমিলিয়ে আমরা একটা বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হলাম।
টেলিভিশন নাটকের প্রযোজকদের সংগঠন টেলিভিশন অ্যান্ড ডিজিটাল প্রোগ্রাম প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অভিনেতা ইরেশ যাকের বলেন, ‘সারা বছর টেলিভিশন নাটকের নির্মাণের পেছনে ১ হাজার থেকে ১২শ কোটি টাকার লেনদেন হয়। যার সিংহভাগ ব্যয় হয় দুই ঈদে। তাই বলা যায় একটা বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হলাম আমরা। এই ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠবো এখনো বুঝতে পারছি না। কারণ, এই ক্ষতির সঙ্গে শুধু অভিনয়শিল্পী জড়িত নয়, একজন মেকআপম্যান, ট্রলিম্যান এমনকি টেলিভিশনের কর্মকর্তাও জড়িত। সবাই মিলেই একটা বড় ধরনের সংকটে পড়েছি।’
টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসির বলেন, করোনা সম্পর্কিত সরকারের যে নির্দেশনা রয়েছে, আমাদের সংগঠন শুরু থেকেই সেগুলো মেনে চলছে। করোনা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, এরজন্য পুরো টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির যে ক্ষতি হয়েছে আগামিতে সম্মলিত প্রচেষ্টায় সে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ঈদে প্রত্যেক প্রযোজক বেশকিছু নাটক/টেলিফিল্মের জন্য ইনভেস্ট করেন। যে কাজগুলোর নব্বই শতাংশের কাজ শুরু হয় ঈদের মাস দুয়েক আগে থেকে! কিন্তু করোনার কারণে এবার সব ভেস্তে গেল। বহু প্রযোজকের হাতে এবার ঈদে নতুন প্রজেক্টই নেই বলেও জানান সাজু।
প্রযোজক সাজু মুনতাসির নিয়মিত নাটক প্রযোজনা করেন। অন্য সবার মতো ঈদকে টার্গেট করে আগেই নাটক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। হাতে সময় নিয়ে ঈদের কাজ শুরু করায় তার কাছে বেশ কয়েকটি নতুন নাটক আছে বলে জানান এই প্রযোজক। তার ভাষ্য: ঈদের আগ মুহূর্তে আর্টিস্ট, সিডিউল নিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। এ কারণে ঈদকে টার্গেট করে একটু আগেই আমি কিছু নাটক, টেলিফিল্ম করে রেখেছিলাম। যেগুলোর কাজ লকডাউনের আগেই শেষ হয়েছে। আমি ছাড়াও আরো কয়েকজন প্রযোজক আছেন, যাদের কাছে কিছু নতুন নাটক রয়েছে।
বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আকন্দ বলেন, ‘দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বড় আয়ের জায়গা দুই ঈদ। নাটক নির্মাণের পাশাপাশি এই সময় নতুন নতুন নাটকের পেছনে স্পন্সর করেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সঙ্গে নাটকের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন প্রচারের একটা সুযোগ থাকে। সবমিলিয়ে বড় একটা আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো টেলভিশন চ্যানেলগুলো।
তবে মাছরাঙা টেলিভিশনের ইনচার্জ (প্রোগ্রাম) আরিফুর রহমান বলেন, বাণিজ্যের জায়গাটা এখনই পুরোপুরি বলা যাবেনা। কারণ আমরা এখন ঈদের পরিকল্পনাটা চূড়ান্ত করছি। নতুন ও পুরোনো নাটক দিয়েই সাজাবো এবার। চূড়ান্তর পরপরই ব্রান্ডিং ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা হবে। তারপরই নিশ্চিত করা যাবে আসলে অবস্থা কী দাঁড়ায়। তবে আর্থিক যে একটা ক্ষতি হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু কী পরিমাণ হবে এখনো বলার সময় আসেনি।
নাগরিক টিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান কামরুজ্জামান বাবু বলেন, অন্যান্যবার ৭ টি একঘন্টার নাটক প্রচার হয়, এবার থাকছে ৪টি। এর পাশাপাশি দুটি সাতপর্বের ধারাবাহিক নাটক থাকছে। যা প্রচারে যাবে সবই নতুন। মার্চে লকডাউন শুরুর আগেই কাজ শেষ করেছিলাম। তাই আমাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে হচ্ছে না।
এ নিয়ে আবার আশার কথা শোনান অভিনেতা ও প্রযোজক ইরেশ যাকের। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিটা সবাইকে বুঝতে হবে। তাই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যারা বিজ্ঞাপন দেন তারাসহ বিজ্ঞাপনী সংস্থা টেলিভিশন চ্যানেলসহ সবাই মিলে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। সবাই চাইলে ঈদে না হলেও পরে যে কোনো সময় একটা উৎসব করে এই ক্ষতি পোষানো সম্ভব। শুধু দরকার সদিচ্ছা।
বাংলাদেশ শুটিং হাউজ ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান জানান, উত্তরা ২৪ এবং গাবতলি, পুরাণ ঢাকা মিলিয়ে ৩০ টি শুটিং হাউজ রয়েছে। ঈদের আগে কাকে ভাড়া দেব এ নিয়ে হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থা পুরোটাই উল্টো। ২২ মার্চ থেকে কাজ পুরোপুরি বন্ধ।
তিনি বলেন, ঈদের আগে শুটিং দুই শিফটে হাউজ ভাড়া হতো। এবার তো মার্চ থেকে পুরোপুরি বন্ধ। ঈদুল আযহাতেও শুটিং হাউজ চালু করতে পারবো কিনা সন্দেহ হচ্ছ। এতে করে প্রতিমাসে সবমিলিয়ে আমাদের শুটিং হাউজ ব্যবসায় ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মতো লোকসান গুণতে হচ্ছে।