আইসল্যান্ডের মতো বিশ্বকাপে নবাগত কোনো দলের কাছে ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনা ড্র করলেও সেটি পরাজয়েরই নামান্তর।
২০১৮ বিশ্বকাপের প্রথম খেলায় আর্জেন্টিনা কেন ‘হেরে গেলো’, ক্রীড়ালেখকরা তার বিশ্লেষণ দিচ্ছেন, দেবেন; এটি আমার কাজ নয়। তবে একজন আর্জেন্টাইন সমর্থক এবং ফুটবলের একজন সামান্য দর্শক হিসেবে বাংলাদেশে ঈদের রাতের এই খেলা নিয়ে একটু ব্যক্তিগত অভিমত শেয়ার করতে চাই।
এই খেলার সবেচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নিঃসন্দেহে ৬৪ মিনিটে মেসির পেনাল্টি মিস। যে কিনা গোলপোস্টের অনেক দূর থেকেও থার্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে করা ফ্রি কিক থেকে গোল করেন, সেরকম একজন জাদুকরী ফরোয়ার্ডের পেনাল্টি মিস কি খুব স্বাভাবিক ঘটনা? পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে, পেনাল্টি মিসের ট্র্যাজেডি মেসির বায়োডাটায় নেহাত কম নয়। এর আগে তিনি আরও ২৩ বার এই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন।
আমরা এই দুর্ভাগ্য শব্দটি নিয়েই এগোতে চাই। পুরো খেলাটি যারা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, খুব অল্প সময়ই আর্জেন্টাইন গোলকিপারের হাতে বল গেছে। বরং অধিকাংশ সময়ই বল ঘুরপাক খেয়েছে মাঝ মাঠের ওপারে আইস ডিবক্সের আশেপাশে। কিন্তু সফল পরিণতি এসেছে মাত্র একবার।
শেষ মিনিটে ডিবক্সের কিছুটা দূর থেকে শেষবারের মতো ফ্রি-কিকের সুযোগ পেলও তা কাজে লাগাতে পারেননি মেসি। এর মিনিট দুই আগে অতামেন্দিও ডিবক্সের ভেতর থেকে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে বল ছুড়লেও তা গ্রিপবন্দি করেন আইস কিপার।
পুরো খেলায় মেসি মোট ১০ বার গোল পোস্ট লক্ষ্য করে কিক করেন, কিন্তু একটিও আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এর আগের দিনই ক্লাব কাপে তার প্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগালের ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো মাত্র চারটি টার্গেট করে তিনটিতেই গোল পেয়েছেন এবং ২০১৮ বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাট্রিকের গৌরবান্বিত মালিক হয়েছেন।
মেসি কেন ঠিক জ্বলে উঠতে পারলেন না? পুরো খেলাটি যারা দেখেছেন তারা খেয়াল করেছেন, যখনই মেসির পায়ে বল, প্রতিপক্ষের তিন চারজন তার সামনে পেছনে প্রতিরোধের দেয়াল তুলে প্রস্তুত। সেই দেয়াল ভেদ করেও তিনি যতগুলো চেষ্টা করেছেন, সেগুলোর কতটা মেসিসুলভ ছিল, তাও আলোচনায় আসছে। তিনি বার্সেলোনায় যতটা উজ্জ্বল, অপ্রতিরোধ্য, প্রাণবন্ত–বিশ্বকাপে নিজের দেশের হয়ে তার সেই জাদুকরী রূপটি ভক্তরা দেখছে না কেন? তারউপর প্রত্যাশার চাপ বেশি? তা তো থাকবেই। পুরো বিশ্ব যার দিকে তাকিয়ে, সব ক্যামেরার লেন্স যাকে ফোকাস করে, পুরো ধারাভাষ্য যখন তার প্রসঙ্গে মসগুল, সেই চাপ মোকাবেলা করেই তো তাকে প্রমাণ করতে হবে, ইয়েস আই অ্যাম মেসি! কিন্তু সেই মেসি কোথায়? সর্বশেষ মিনিটে ডিবক্সের কিছুটা দূর থেকে তিনি যখন সর্বশেষ ফ্রিকিকটি করতে এলেন, ঘামে জবুথবু মুখে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু ভক্তরা অতশত বোঝে না। তারা মেসির পায়ে গোলের চিহ্ন দেখতে চায়।
আরেকটা ব্যাপার নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, পুরো খেলায় আর্জেন্টাইন ছন্দ থাকলেও তা ছিল গতিহীন। অনেকগুলো বল গোলপোস্ট লক্ষ্য করে তারা ছুড়েছেন, কিন্তু সেগুলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গতিময় এবং শক্তিশালী ছিল না। ৭০, ৭২, ৭৫, ৭৬, ৭৮, ৮০ মিনিটে তারা গোলপোস্ট লক্ষ্য করে বল ছুড়লেও হয় সেগুলো কব্জি-বন্দি করেছেন গোলরক্ষক না হয় গুলি চলে গেছে কানের পাশ দিয়ে।
৭৬ মিনিটে ডিবক্সের ভেতরে আইসল্যান্ডের একজন খেলোয়াড় ২২ নম্বর জার্সিপরা আর্জেন্টিনার পেভনকে ফেলে দিয়ে পরিষ্কার ফাউল করলেও তা আমলে নেননি রেফারি। এমনকি তিনি ক্যামেরার সাহায্যও নেননি। নিলে আর্জেন্টাইনরা আরেকটি পেনাল্টি পেত এবং খেলার ফলাফল আশা করা যায় ২-১ এ শেষ হত। কিন্তু এখানেও ভাগ্যদেবতা বোধ হয় তাদের সহায় ছিলেন না! এভাবে বারবারই তারা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন।
৮৭ মিনিটে মাশ্চেরানোর একটি গোলের সম্ভাবনাময় বল ধরে ফেলেন আইসল্যান্ডের গোলকিপার। এর ঠিক এক মিনিট আগেও তিনি একইভাবে প্রতিহত করেন। অর্থাৎ আর্জেন্টিনার প্রতিটি আক্রমণই তিনি যেভাবে প্রতিহত করেছেন, তাতে শুধু এই ম্যাচটিই নয়, এবারের পুরো বিশ্বকাপেই আলোচিত হয়ে থাকবেন লাল জার্সিপরা আইসল্যান্ডের এই গোলরক্ষক হল্ডরসন। বিশেষ করে মেসির পেনাল্টি রক্ষার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘আমি ভালোভাবে অনুশীলন করেছি। মেসির অনেক পেনাল্টি দেখেছি। আগের পেনাল্টিগুলোয় আমি কেমন করি, সেটিও বারবার দেখেছি। চেষ্টা করেছি তাদের (যাঁরা পেনাল্টিগুলো নিয়েছিলেন) মনের অবস্থা বুঝতে।’
তবে বিপরীতে এই খেলায় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে আর্জেন্টিনার দুর্বল ডিফেন্স। আইসল্যান্ডের খেলোয়াড়রা মাত্র বারকয়েক ডিবক্সে ঢুকে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে কামানের গোলা ছুড়লেও তাতেই দুবারের বিশ্বকাপজয়ী এই দলের ডিফেন্সে যে দুর্বলতা টের পাওয়া গেছে, তা চোখে পড়ার মতো। ইনজুরিতে পড়া গোলরক্ষক রোমেরোর শূন্যতা যে এবার আর্জন্টাইন শিবিরকে ভোগাবে, তাতে সন্দেহ কম।
কিন্তু এতকিছুর পরও আর্জেন্টিনা সস্পর্কে কী প্রেডিকশন করা যায়? মনে রাখা দরকার, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবার তাদের বিশ্বকাপে আসা অনিশ্চিত ছিল। ইতালি নেদারল্যান্ডের মতো দেশও এবার বাছাই পর্ব থেকে ছিটকে পড়েছে। তবে বাছাইপর্বে টেনেটুনে পাস আর্জেন্টিনা হয়তো এভাবেই টেনেটুনে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠবে এবং শেষমেষ ফাইনালও খেলবে। এটি একজন আর্জেন্টাইন সমর্থকের প্রত্যাশা। কিন্তু ফুটবলে প্রেডিকশন করা যে কঠিন, তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছে ১৫ জুন স্পেন-পর্তুগালের ম্যাচ। সুতরাং শেষ বলে কিছু নেই। আর সবশেষ কথা, আবেগ- ভালোবাসা-উত্তেজনা-উন্মাদনা যতই থাকুক, আলটিমেটলি খেলা খেলাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)