যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো একজন প্রেসিডেন্ট অভিশংসন বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকবেন কি না; ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাত ১২টা) মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে সেই ফয়সালা করতে শুনানি হতে যাচ্ছে।
এমন একটি বিচারকাজের ফল হিসেবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পদচ্যুতও হতে পারেন, এবং সেটি হবে সবার জন্যই বেশ বড় একটি ধাক্কা, কেননা এর আগের দু’জন প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হলেও তাদের কাউকেই অফিস হারাতে হয়নি।
তবে ক্ষমতাচ্যুত হোন, বা না হোন, একজন প্রেসিডেন্টকে যে এমন একটি মামলা ও বিচারের মুখে পড়তে হচ্ছে সেটাই তো একটা বিশাল ব্যাপারই।
তাই এখানে পাঁচটি প্রশ্ন আর তার উত্তর তুলে ধরা হচ্ছে, যার মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন ও সিনেটে এর বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে পাঠকরা ধারণা পাবেন।
১. অভিশংসন কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের সিনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তারা মিলে ভিন্ন কোনো উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাকে (যেমন, বিচারপতি, প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রিসভার সদস্য) জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো অপরাধ করার অভিযোগ উঠলে তার ভিত্তিতে এই জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা।
এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে: রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষগ্রহণ বা প্রদান অথবা কোনো গুরুতর অপরাধ বা লঘু পর্যায়ের অপকর্ম।
যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে অভিশংসিত হলে সেই মামলা চলে যায় সিনেটে। সিনেট সদস্য বা সিনেটররা তখন ঠিক করেন সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী কিনা। তবে এটি অবশ্যই একটি রাজনৈতিক মামলা, ফৌজদারি মামলা নয়।
২. ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী কী?
অভিশংসনের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মোট ২টি অভিযোগ রয়েছে।
প্রথমত, তার বিরুদ্ধে গত নভেম্বরে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে তাকে জিততে সাহায্য করার জন্য ইউক্রেন সরকারকে চাপ দেয়ার অভিযোগ। এই দর কষাকষির জন্য ট্রাম্প কোটি কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা ইউক্রেনকে দেয়ার কথা থাকলেও না দিয়ে আটকে রেখেছিলেন এবং হোয়াইট হাউজে দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকও আটকে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীদের দাবি, দর কষাকষির এই হাতিয়ারগুলোর বিনিময়ে ট্রাম্প চেয়েছিলেন যেন ইউক্রেন সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে আনুষ্ঠানিক তদন্তের ঘোষণা দেয়।
জো বাইডেন আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী। জরিপ অনুসারে, জো বাইডেনকে ডেমোক্রেটিক পার্টি তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বেছে নিলে ট্রাম্পের হারার সম্ভাবনাই বেশি।
দ্বিতীয়ত, গত বছর হোয়াইট হাউজ অভিশংসনের প্রথম পর্যায়ের শুনানিতে তার কর্মীদের সাক্ষ্য দিতে না দিলে ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ তোলেন যে ট্রাম্প কংগ্রেসের কাজে বাধা দিচ্ছেন।
ট্রাম্প সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার লিগ্যাল টিম বলেছে, এই অভিযোগগুলো একেবারেই ঠুনকো এবং এগুলো সংবিধানের ভয়ঙ্কর বিকৃতি।
৩. এ নিয়ে কেন বিচার হচ্ছে?
কেন এ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নিচের সংক্ষিপ্ত ঘটনাপ্রবাহে এর একটি ধারণা পাওয়া যাবে:
- আগস্ট ২০১৯: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রথম ওপরের অভিযোগগুলো তোলেন।
- অক্টোবর-ডিসেম্বর: অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয় সেই তদন্ত গিয়ে গড়ায় হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের শুনানিতে, যা ডেমোক্রেটিক দলের দখলে।
- ডিসেম্বর: হাউজের ডেমোক্র্যাট নেতারা ভোটাভুটির মাধ্যমে ট্রাম্পকে অভিশংসিত করেন।
- জানুয়ারি ২০২০: অভিশংসন মামলাটি সিনেটে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় যেখানে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণ। এবার সেখানেই বিচার কাজ চলবে।
৪. সিনেটের মামলায় কী কী বিষয় থাকে?
অভিশংসন বিচারকাজ ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি বিষয়ে মার্কিন সংবিধানে পুরোপুরি স্পষ্ট করে বলা নেই। তবে ১৮৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের অভিশংসন বিচার প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে কিছু সাধারণ নীতিমালা রয়েছে। ওই মামলায় প্রেসিডেন্ট কোনমতে নিজের চাকরিটা বাঁচিয়েছিলেন।
এরপর বিল ক্লিনটনও ১৯৯৯ সালে একইভাবে সিনেটে অভিশংসনের বিচারে নিজের পদ ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
অভিশংসন মামলার বিচারকাজ কীভাবে হবে তা ঠিক করছেন মূলত দুইজন: সিনেটের রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল এবং ডেমোক্র্যাট প্রধান চাক শুমার।
সাক্ষী, প্রমাণ প্রতিটি শুনানির সময় এবং যুক্তিতর্কের সবরকম গাইডলাইনে তাদের দু’জনের সম্মতি লাগবে। কিন্তু যেহেতু সিনেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে রিপাবলিকান দল, সেহেতু সব প্রক্রিয়ায় শেষ কথাটা হবে ম্যাককনেলের। মঙ্গলবারে বিচার প্রক্রিয়ার নীতিমালা নিয়ে সিনেটরদের মাঝে ভোটাভুটি হবে।
৫. মূল খেলোয়াড় কারা?
ম্যাককনেলসহ প্রত্যেক সিনেটরই বিচার চলাকালে ‘পক্ষপাতহীন ন্যায়বিচার’ প্রদানের শপথ নিয়েছেন। অথচ সিনেটের জ্যেষ্ঠতম সিনেটর ম্যাককনেল কিন্তু গত মাসেই বলেছিলেন, ‘আমি একজন নিরপেক্ষ বিচারক নই।’ তিনি আরও বলেছিলেন, তিনি এবং তার দল হোয়াইট হাউজের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।
ম্যাককনেলের এসব মন্তব্যে ক্ষিপ্ত সিনিয়র ডেমোক্র্যাটরা।
এখন এই মামলার মূল বিচারকের ভূমিকায় আর নেই মিচ ম্যাককনেল। কাজটি চলে গেছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের হাতে। কিন্তু তারপরও ১শ’ জন সিনেটরের সবাই একাধারে বিচারক এবং জুরি হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন। বিচারপতি রবার্টস শুধু নিশ্চিত করবেন বিচার প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক হচ্ছে কিনা।
সাতজন ডেমোক্র্যাট ইমপিচমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে থাকবেন। তারা মূলত হাউজের পক্ষ থেকে আইনজীবীর ভূমিকা পালন করবেন। এদের মধ্যে গোয়েন্দা কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম শিফ এবং বিচারিক কমিটির চেয়ারম্যান জেরি ন্যাডলারও রয়েছেন, যারা দফায় দফায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের রোষানলের শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সিনেটে মামলা লড়বে যে দলটি তার মধ্যে রয়েছেন বিল ক্লিনটনের অভিশংসনের সময় তার মামলা লড়া কেন স্টার ও রবার্ট রে। এছাড়াও থাকছেন ওজে সিম্পসনের সাবেক আইনজীবী অ্যালেন ডারশোউইজ, হোয়াইট হাউজ কাউন্সেল প্যাট চিপোলোনি এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী জে সেকুলো।
(সূত্র: বিবিসি)