সন্দ্বীপের সাড়া জাগানো শিশু অপহরণের ঘটনায় পুলিশ এবং স্থানীয় জনগণ যেভাবে একসাথে কাজ করেছে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা চলছে।
গত ২০ নভেম্বর আহসান হোসেন জারিফ নামে এক শিশু অপহরণের শিকার হয়।
জারিফকে উদ্ধারের প্রচেষ্টায় তার পরের দু’দিন ধরে বহু তরুণ সন্দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু করে। এই অপহরণের ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে দেয়ার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও ব্যবহার করে।
এরপরই সেদিন গভীর রাতে অপহরণকারীরা জারিফের ব্যবহার করা স্কুল ড্রেস ও একটা চিঠি বাড়ির বাইরে ফেলে রেখে যায়। আর তাতে মুক্তিপণ হিসেবে চার লাখ টাকা দাবি করা হয়।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
পরদিন সকালে জারিফের বাবা মো. জ্যাকব থানার সাথে যোগাযোগ করেন।
তারপর কী হলো?
শিশু জারিফের অপহরণের শিকার হওয়ার পর থেকে এই প্রতিবেদকসহ আরও বেশ কয়েকজন তাকে উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকায় নামেন। এরা হলেন: আব্দুল হান্নান তারেক, ফিরোজ খান পাবেল।
এরই ধারাবাহিকতায় জারিফের বাবা থানায় যোগাযোগ করলে সন্দ্বীপ থানার এসআই মো. হেলাল খানসহ কয়েকজন এসআই জ্যাকবের বাড়িতে আসেন। তারপর সন্দ্বীপ থানায় এই ঘটনা জিডি করা হয়।
আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে আমরা এই অপহরণ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করি।
এরপর স্কুল ভ্যান ড্রাইভারকে সনাক্ত করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। পাশাপাশি এই কাজে আমরা সাধারণ মানুষকে জড়িত করি।
জারিফের বাবা মো. জ্যাকব যেমন মাইকিং শুরু করেন, তেমনি আমরাও অভিযানে নেমে পড়ি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সজাগ করার চেষ্টা করি।
অপহরণকারীরা চিরকুটে যে মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়েছিল আমরা তার অবস্থান জানার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
একপর্যায়ে এই অপহরণের ঘটনাটি নিয়ে এতটাই হৈ-চৈ শুরু হয় যে স্থানীয় যুবকরা সিদ্ধান্ত নেন তারাও তাদের মতো করে প্রশাসনকে সহায়তা করবেন।
সকলের সহযোগিতা কামনা করে জ্যাকব ভাইয়ের একটি এক মিনিটের ভিডিও পোস্ট করি। যেটা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে।
সকাল হওয়ার আগে ঠিক ফজরের আগ মুহুর্তে জ্যাকব ভাই আমাকে জানালেন রাতে জারিফের স্কুল ড্রেস ও সাথে একটা চিরকুট বাড়ির উঠোনে রেখে গেছে অপহরণকারীদের কেউ একজন।
চিরকুটে একটি ফোন নাম্বার ছিলো। আমি সেটা আমাদের মোবাইলে সেভ করলাম। দেখলাম ইমোতে তাহমিনা নামে একটা আইডি শো করছে। এটা ছিল আমাদের প্রথম ক্লু।
আমি জ্যাকব ভাইকে ছবি এবং এই নামে কাউকে চেনে কিনা জিজ্ঞাস করলাম। কিন্তু চিনলেন না। বললেন, আমাদের ফুপাতো বোনের মেয়ে আছে নাম তাহমিনা। তবে সে এই কাজ করতে পারে না।
তারপর পুলিশ মোবাইল নাম্বার ট্র্যাক করে জানালো যে সেটা গত সাত দিন ধরে বন্ধ।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর আমাদের টিম একমত হলাম যে, প্রশাসনের পাশাপাশি আমরা এই ক্লু ধরে নিজেদের মত করে এগোবো। অনুমতি নিলাম জারিফের বাবার থেকে।
তারপর আমরা রবির নাম্বারটা নিয়ে চট্টগ্রামে আকবর নামে আমাদের এক বন্ধুকে ফোন করে সাহায্য চাই। নম্বরটা কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা তা বের করে দিতে বলি।
সে জানালো সে শুধু আইডি নাম্বার আর ডেট অব বার্থ দিতে পারবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেটা পেয়ে গেলাম।
এখন কাজ আইডি কার্ড বের করা। কিন্তু সকাল হওয়ায় সব বন্ধ থাকায় তখন নেয়া সম্ভব ছিল না।
চ্যানেল আইয়ের প্রডিউসার সওকত আলি ও আমাদের বন্ধু এক্সিম ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ বাবর ইসলামের সহায়তায় আমরা আইডি কার্ড-এর তথ্য জোগাড় করি।
সেই তথ্য ইমোতে পাওয়া নামের সাথে তা মিলে যায়।
এসে গেলো খুশির বার্তা। পাওয়া যায় ঠিকানা। যা জারিফদের বাড়ি থেকে খুব একটা দুরে না। কয়েক মিটিটের পথ। এবার আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমরা ঐ বাড়িটিতে অভিযান চালাবো খুব গোপনে এবং ভাগে ভাগে।
ঠিক হলো প্রথমে তিন-চার জনের একটা দল ওই ঠিকানায় যাবে।
আমি পুলিশের লোকজনসহ ২০০/৩০০ গজের মধ্যেই থাকবো। ফোন করা মাত্রই আমরা হাজির হয়ে যাব।
অপহরণকারীদের বাড়ি থেকে একটু দূরে দর্জি পুকুর মোড়ে জারিফের বাবাকে নামিয়ে দেয়া হয়। নিয়ে নিলাম আরো দু’জনকে। ফিরোজ খান ও হান্নান তারেকসহ এলাকার ২ মেম্বার কে নিয়ে জারিফের সন্ধানে গেলাম অপহরণকারীদের বাড়িতে।
জারিফ অপহরণের খবরে স্থানীয় থানায় উদ্বিগ্ন মানুষ
এখানে বলে রাখি যেহেতু আমরা প্রশাসনের কেউ না তাই কোনো বাড়িতে সার্চ করতে গিয়ে যাতে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সে জন্য আমরা স্থানীয় মেম্বারদের সাহায্য নিয়েছি।
এছাড়াও আমরা আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি কারণ অপহরণকারীরা সংঘবদ্ধ হতে পারতো। তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারতো।
কিন্তু সব ঝুঁকি ছাপিয়ে আমাদের কাছে মুখ্য ছিল জারিফকে উদ্ধার করা। তারপর স্থানীয় মেম্বারকে সাথে নিয়ে আমাদের দল তাহমিনার ঘর খুঁজে বের করে।
তাহমিনার ঘরের সামনে একজন দাঁড়ানো দেখে নাম জিজ্ঞাসা করার পর সে নিজেকে ফাহিমা নাম বলে। কিন্তু ভ্যান ড্রাইভারের বিবরণে বলা হয়েছিল জারিফকে যে নারী নিয়ে গেছে সে গর্ভবতী ছিল। ওই নারীও গর্ভবতী দেখে তাকে আটক করা হয়।
তার নাম, বাবার নাম এবং তার আইডি’র ছবি থেকে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল।
তখন ফিরোজ তার ঘরে ঢুকে পড়ে। অন্ধকার ঘরে ঢুকে সে দেখে কম্বল জড়ানো একটি শিশুকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর জারিফকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। ফোন পাওয়া মাত্র আমাদের ফোর্স গিয়ে সেখানে হাজির হয়।
ওই মহিলাকে আটক করা হয় এবং জারিফকে তার বাবার কোলে তুলে দেয়া হয়।
এই ঘটনার পর আটক মহিলার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আমরা আরও কয়েকজনকে আটক করা হয়।
পুলিশ জানায়, মামলার তদন্ত এখনও চলছে। আজ ২৫ নভেম্বর জারিফ অপহরণ মামলার আসামিদের কোর্টে তোলার কথা রয়েছে।