ক্যান্সার একটি ভয়াবহ ব্যাধি। পুরো পৃথিবীর মানবজাতির জন্য হুমকি। এই ব্যধি মানুষের শারীরিক সক্ষমতাকে কেড়ে নিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। ক্যান্সার নিরাময়ের ঔষধ আবিষ্কারের জন্য গোটা বিজ্ঞানী জাতি আজ ও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন । বাংলাদেশে কতজন মানুষ প্রতিদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন তার হিসাব মেলানো হয়ত কঠিন, তবে সেটা যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তুলনায় যৎসামান্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। National Committee to Protect Shipping, Roads and Railways (NCPSRR) পর্যবেক্ষণ করেছেন গত ছয় মাসের ( জানুয়ারি – জুন, ২০১৭) ২২ জাতীয় পত্রিকা, ১০ আঞ্চলিক পত্রিকা, ও ৮ টি অনলাইন পত্রিকা। NCPSRR প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ছয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিমাণ ২২৯৭ জন ও আহতের পরিমাণ ৫৪৮০ জন। যা গত বছরের তুলনায় মৃত্যুর পরিমাণে বেড়েছে ১৮.৩৫% এবং সড়ক দুর্ঘটনায় বেড়েছে ৮.৬%। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের নজরে আসছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। যখন আমি লিখছি, তখন হয়ত আমাদের সড়ক কারও না কারও রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না এই দুর্ঘটনা ! কিন্তু কেন ?“ জন্মালে মরতে হবে “ধ্রুব সত্য কথা।মৃত্যু তো অবধারিত কিন্তু এই মৃ্ত্যুর দায় কার? সেটার উত্তর কি আমাদের জানা নেই। চলতেই থাকবে কি এই লাশের মিছিল!!!
গত ২৮ জুন, ২০১৭, ঈদের দুই দিন পর, আমার এক বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ছাত্র – শিক্ষক কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একটু আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটা বর্জ্যপরিবাহী ট্রাক পিছন দিক থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তাঁদের মোটরবাইককে সজোরে ধাক্কা দেয় এবং তারপর মাটিতে পড়ে যাওয়া স্ত্রীর শরীরের উপর দিয়ে সজোরে চলে যায়। প্রতিদিন টিভিতে ভেসে আসে সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ। ভেঙ্গে যায় অনেক পরিবারের লালিত স্বপ্ন। বাংলাদেশের আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরের দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ হারিয়েছে দুইজন রত্ন। এই রকম উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না কারণ চলছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক অত্যন্ত জরুরী। কারণ, মানুষ কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছে দিক্বিদিক। আবিস্কারের নেশায় ও জীবিকার তাগিদে মানুষের অবিরত ছুটে চলা।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০২ মার্কিন ডলার , প্রবৃদ্ধি ৭.২৪% ( সূত্রঃ Planning Ministryof Bangladesh , 2017) । বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে, নতুন নতুন যোগাযোগ খাত তৈরি হচ্ছে, অবকাঠামো ওসড়ক নির্মাণ চলছে মানুষের যাতায়াতকে সহজতর ও আরামদায়ক করবার নিমিত্তে। কিন্তু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক পৃথিবীতে পরিকল্পনার ও চিন্তার প্রসার ঘটেছে। অথচ, ক্যান্সারের চেয়ে ভয়াবহ এই সামাজিক ব্যাধি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে রয়েছে সঠিক পরিকল্পনা ও চিন্তার ঘাটতি। পরস্পরকে দোষারোপই হয়ে উঠেছে মূল পাথেয়। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা চালক ও মালিককে, চালক ও মালিকরা ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের, মালিক চালককে , চালক মালিককে প্রভৃতি পরস্পরকে অভিযোগ করেই যাচ্ছে। অনেকে দায়ী করেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতিকে, দায়ী করেন উল্টাপথে গাড়িচালনাকে।তবে যাই হোক না এই পরস্পরকে অভিযোগের দায় বয়ে বেড়াচ্ছে পুরো জাতি। মালিকদের করনীয় ফিটনেস সমৃদ্ধ ও বৈধ লাইসেন্স যুক্ত গাড়ি রাস্তায় চালনা করা কারণ ফিটনেসবিহীন গাড়ী সাময়িক লাভের পাত্র হতে পারে, তবে তা শত শত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। একজন চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে পুঙ্খনুপুঙ্খরুপে যাচাই বাছাই করা দরকার কারণ নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত হতে পারে নিরাপদ মানুষের হাতে। যাতে অযাচিত ও অতিরিক্ত বেগে, বিধি ভঙ্গ করে যানবাহন রাস্তায় চলাচল করতে না পারে সেই ব্যপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি কাম্য। বিধি ভঙ্গকারী যদি ক্ষমতাবানও হন , তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। ধারনা করা হয়ে থাকে, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালকদের বেপরোয়া গাড়ী চালনা ও অভার টেকিং । এটা চালকের ধৃষ্টতা। চালকের মদ্যপ অবস্থায় গাড়ী চালনা, গাড়ী চলন্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যাওয়া , শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। তবে, আমরা কি চালকদের বয়স ও শ্রম ঘণ্টার ব্যাপারে ভেবেছি । যেখানে একজন সরকারি/ বেসরকারি চাকুরীজীবীদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা আছে, সেখানে একজন চালকের কর্মঘণ্টা কি নির্ধারণ করা আছে! সব গাড়ির চালক কি মদ্যপান করে? সব চালকই কি অশিক্ষিত !এই ভাবে সর্বজন চিন্তা সমাজের যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য ভয়ংকর। যতই দক্ষ চালক হোন না কেন ফিটনেসবিহীন গাড়ী তার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর নয়। অনির্ধারিত শ্রম ঘণ্টায় গাড়ী চালনা চালকদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। চালকদের শ্রম ঘণ্টা নির্ধারণ ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা জরুরী। যদি কোন চালক অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ বাবস্থা গ্রহন করতে হবে।
এখন, আমরা একটু রাস্তার চিত্র লক্ষ্য করি। যত্রতত্র পারকিং, হঠা রাস্তার গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার , চালকের অজ্ঞাতসারে বাস উল্টে যাওয়া ইত্যাদি। একটা প্রশ্ন জাগে, আমাদের মহাসড়কগুলো কি আসলেই পরিকল্পিত ! রাস্তার মাঝখান দিয়ে কি একমুখী চলাচলের জন্য ভাগ করা আছে ? মানুষের পারাপারের জন্য পরিকল্পিত ওভারব্রিজ বা জেব্রা ক্রসিঙের দাগগুলো স্পষ্টত দৃশ্যত কিনা ? নির্দিষ্ট গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট লেন ঠিক আছে কিনা ? দুর্ঘটনাপ্রবণ অঞ্চলগুলো চিন্হিত করা আছে কিনা ? মহাসড়কে অনেক মালবাহী ও দ্রুতগতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচল করে , সেখানে কমগতিসম্পন্ন ও হালকা যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম কার্যকর আছে কি ? এই রকম অনেক সমস্যাবলী চিন্হিত করার চিন্তা আমাদের মাথায় কখনও এসেছে কি ! রাস্তায় বিভিন্ন বাঁক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মাঝে মাঝে এমনভাবে রাস্তা ম্যাপিং করা থাকে, যেখানে অপর পাশে কি আছে তা বোঝা দুষ্কর। এই সমস্ত বিষয়াবলী নিয়ে গবেষনায় মনোযোগ খুবই জরুরী। আর ও একটা বিষয়, রাস্তাগুলো নির্মাণ বা মেরামতের সময় সঠিক তদারকি হয় কিনা ? কারণ, সরকারের পর্যাপ্ত বাজেট নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কাজের গাফিলতি ও দুর্নীতির ফলে বাংলাদেশের অনেক রাস্তা বছর গড়াতে না গড়াতেই নষ্ট হয়ে যায় । স্প্রিড ব্রেকারের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। স্প্রিড ব্রেকারে পর্যাপ্ত সাদা রঙের মাধ্যমে নির্দেশনা দিলে সেটি চালক ও জনসাধারণের জন্য বুঝতে সুবিধাজনক। সাদা রঙের মাধ্যমে নির্দেশনা বিহীন স্প্রিড ব্রেকার এমনভাবে রাস্তার সাথে মিশে থাকে যা অনেক দুর্ঘটনার কারণ। “সামনে গতিরোধক” এমন নির্দেশনার ও অভাব লক্ষণীয়। সড়কের অবকাঠামোগত সমস্যার কারনে অনেক সময় চালকের পক্ষে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। শুধু চালককে দোষারোপ করে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর মিছিল থামাতেই হবে। এগিয়ে নিতে হবে নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলন, নতুবা দেশীয় উন্নয়ন গতি মারাক্তকভাবে ব্যহত হবে। পর্যাপ্ত গবেষণা, কার্যকরী কৌশল , জনসচেতনতা সর্বোপরি , সড়কদুর্ঘটনারোধেআলাদা নীতিমালা ও আইন বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবী। আমরা আর দেখতে চাই না, “ সড়কে মৃত্যুর মিছিল” ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)