রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’ আলোকচিত্রের ক্যাপশন লিখতে গেলে এই কথার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। বড় ছবি- তার ছোট্ট একটি ক্যাপশন। যত ছোটই হোক তা ‘যায় না লেখা সহজে’। ক্যাপশন লেখা আলোকচিত্রী, লেখক, সম্পাদক- সবার জন্যই একটি চ্যালেঞ্জ। মেদহীন দু-এক লাইনে ছবির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারওপর রয়েছে, বানান ও বাক্যগঠন ঠিক রাখা এবং সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার ঝক্কি।
ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বলছে, ‘ক্যাপশন হলো, একটি ছোট্ট লেখা- যা বই, ম্যাগাজিন অথবা সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া ছবির নিচে থাকে। এই ক্যাপশন ছবিটিকে ব্যাখ্যা করে অথবা ছবিতে থাকা মানুষ কি করছে বা বলছে তা জানায়।’ কলিন্স ডিকশনারিও অনেকটা একই কথা বলে, ‘ক্যাপশন ছবি বা ব্যঙ্গচিত্রের বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়।’ প্রখ্যাত মার্কিন আলোকচিত্র-সমালোচক ন্যান্সি নিউহল ১৯৫২ সালে প্রকাশিত দ্য ক্যাপশন শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, ক্যাপশন হলো ‘ছোট ছোট সর্বোচ্চ চার লাইনের সংক্ষিপ্ত তথ্য- যা ছবির সঙ্গে থাকে এবং আমাদের ছবিটিকে বুঝতে সাহায্য করে। আর মাঝে মাঝে ছবিটি সম্পর্কে আমাদের ভাবনাকে প্রভাবিতও করে।’
ছবি তো নিজেই কথা বলে তাহলে আবার ক্যাপশনের দরকারটা কি? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমি বলি, আমরা তো মুখেই কথা বলতে পারি- তাহলে মাইকের প্রয়োজন হয় কেন? ক্যাপশনটা হলো, আলোকচিত্রের মাইক। বেশি মানুষের সঙ্গে ছবিটির যোগাযোগ বাড়াতে তার ক্যাপশনের প্রয়োজন পড়ে। যোগাযোগ প্রসঙ্গে আলোকচিত্রী ও ডিজাইনার সৈয়দ লতিফ হোসাইনের ক্যাপশন সম্পর্কে মন্তব্যটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বললেন, ‘যোগাযোগের অন্য যে কোনো মাধ্যমের মতোই আদর্শ ক্যাপশনও সেটাই- যা পরিপূর্ণভাবে যোগাযোগের উদ্দেশ্য সাধন করে। সেসব উপাদান- অর্থাৎ, ছবিটির বিষয়বস্তু, ছবি প্রকাশের উদ্দেশ্য, পাঠক-দর্শক, প্রেক্ষিত, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ইত্যাদি বিবেচনায় আদর্শ ক্যাপশনের দৈর্ঘ্য, বিস্তার, গভীরতা, ভাষা, শব্দচয়ন, নির্ভর করবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ক্যাপশনের অনুপস্থিতিও হতে পারে আদর্শ ক্যাপশন।’ ওই তো- অনেক সময় মাইক না হলেও চলে আরকি।
যদিও বলা হচ্ছে, ক্যাপশন ছবিকে ব্যাখ্যা করে- এই ব্যাখ্যা মানে কিন্তু রামায়ণ নয়। ক্যাপশনটি হবে সংক্ষিপ্ত, ঝরঝরে ও পূর্ণাঙ্গ। ক্যাপশন ছবির ছায়ার মতো- সাথে সাথে থেকেও নেই। লেখক ও চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খানের মতে, ক্যাপশন হলো ‘ছোট করে ছবির পেছনের কথা। মানে যেটা দেখছি সেটাতো দেখছিই, ছবিতে যেটা দেখছি না, কিন্তু ছবিটার ব্যাখ্যা দেয় ছোট করে সেই কথা।’

ক্যাপশন লেখার আরো একটি শর্ত পাওয়া গেলো, ‘ছবির পেছনের কথা’। এই ছবির পেছনের কথার ব্যাখ্যা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজলী সেহ্রীন ইসলাম। বললেন, ‘আমরা জানি, একটি ছবি হাজার শব্দের সমান। তাই অনেক সময়ই ছবির ক্যাপশনের প্রয়োজন পড়ে না অথবা যে ছবি কথা বলে তার ক্যাপশন দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। দর্শক হিসেবে আমরা ছবিতে যা দেখছি ক্যাপশনে তা বর্ণনা করার চেয়ে ছবির গল্পটা বলা উচিত। আক্ষরিক বর্ণনা একঘেয়ে- বিশেষ করে মানুষ বা কোনো পরিস্থিতির ক্ষেত্রে।’ আরো যোগ করলেন, ‘ছবিটি কেন বিশেষ? ছবিতে আমরা মানুষকে যা করতে দেখি তা সে কেন করছে? অথবা যে অবস্থা বা পরিস্থিতির কথা বলা হচ্ছে তা কেন হলো? ধরুন, একজন রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। পেছনে সে কি ফেলে যাচ্ছে? কেন যেতে হচ্ছে? কিসের খোঁজে- কিসের আশায় তারা ছুটছে? ক্যাপশনে এসব প্রশ্নের উত্তর বেশি জরুরি। আমি জানি, এক লাইনে পুরো গল্প বলা যায় না-আবার অল্প কথায় গল্পটা বলাই ভালো ও গভীর লেখার লক্ষণ।’
অনেকটাই পরিষ্কার হলো। এও বুঝা গেলো, আলোকচিত্রী হওয়ার পাশাপাশি লেখালেখিতে কম-বেশি দক্ষতা থাকাও জরুরি। পাশাপাশি জানলাম- ক্যাপশন লেখার ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। রয়েছে কিছু শর্ত। শর্তগুলো দেশ-কাল-সংবাদমাধ্যম ভেদে এদিক-ওদিক হয়। কিন্তু ক্যাপশনের মৌলিক জায়গাটা সবখানে প্রায় একই। ছবির ক্যাপশনের সেই মৌলিক অংশগুলো হলো,
১. ছবির ক্যাপশনে দেয়া প্রতিটি তথ্য সত্য ও নির্ভুল হতে হবে।
২. ছবিতে থাকা মানুষ, স্থান ও ঘটনা সম্পর্কে তথ্য থাকবে।
৩. ছবি তোলার সঠিক তারিখ ও সময় উল্লেখ করতে হবে।
৪. ছবির মানুষ বা ঘটনার পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ধারণা দেয়া যেতে পারে।
৫. ক্যাপশনের বাক্য পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। বাক্য পড়ে যেন অসম্পূর্ণ মনে না হয়।
৬. বর্তমান ক্রিয়াকালে ক্যাপশন লিখতে হয়। (যেমন- ‘তিনি ঘুমান’ বা ‘ঘুমাচ্ছেন’, ‘ঘুমাচ্ছিলেন নয়’)
৭. শব্দ, বাক্য বা তথ্যের পুনরাবৃত্তি বর্জন করতে হবে।
৮. বানান ও বাক্যগঠন শুদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৯. ছবিতে থাকা কারো নাম প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অনুমতি থাকা জরুরি।
১০. যে সংবাদমাধ্যম ছবিটি প্রকাশ করবে তার নীতিমালার সঙ্গে ক্যাপশনটি সাংঘর্ষিক কিনা তা বিবেচনায় রাখতে হবে।
১১. ক্যাপশনটি দেশের আইন-বিরুদ্ধ কিনা তাও মাথায় থাকা চাই।
১২. ক্যাপশনে কোনো সিদ্ধান্ত পৌঁছানো যাবে না। ক্যাপশন যেন উদ্দেশ্যমূলক না হয়।
১৩. ক্যাপশন হবে প্রভাবমুক্ত, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ।
১৪. পুরো ক্যাপশনের দৈর্ঘ্য হওয়া উচিত এক থেকে দুই লাইন।
১৫. ক্যাপশনের শেষে আলোকচিত্রীর নাম (ক্রেডিট লাইন) যোগ করা হয়।
প্রভাবশালী ফটো-এজেন্সি এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর ক্যাপশনগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা ক্যাপশন করতে একটি সরল পদ্ধতি অবলম্বন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তাদের একটি পুরো ক্যাপশনে মাত্র দুটি বাক্যের হয়ে থাকে। প্রথম বাক্যে ছবিটি কি দেখাচ্ছে তা জানানো (বর্তমান ক্রিয়াকালে) হয় এবং কোথায়-কখন ছবিটি তোলা হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়। দ্বিতীয় বাক্যে ছবির ঘটনা বা ব্যক্তির পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড অথবা কেন ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝানোর চেষ্টা থাকে।
অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ফাউন্ডেশন তাদের প্রতিযোগীদের জন্য ক্যাপশন লেখার একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছে। তারা চায়, ক্যাপশনের প্রথম অংশে জানাতে হবে- ছবিতে যাকে বা যাদের দেখা যাচ্ছে তারা কারা, ছবিতে হচ্ছেটা কি, ছবিটি যেখান থেকে তোলা হয়েছে সেই জায়গার নাম (দেশ, জেলা ও শহর), ছবি তোলার তারিখ এবং ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে না সেই তথ্যও (যেমন- পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় মোট ১০ জন নিহত হয়েছেন)। দ্বিতীয় অংশ ছবির গুরুত্বকে তুলে ধরবে এবং তথ্যের সূত্র উল্লেখ করবে।
এবার আসা যাক ক্যাপশনের প্রকার ভেদে। ক্যাপশন ক্যাপশনই, এর নির্ধারিত শাখা-প্রশাখা নেই। তারপরও ন্যান্সি নিউহল ক্যাপশনকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন-১. ন্যারেটিভ (বর্ণনাত্মক) ক্যাপশন এবং ২. এডিটিভ (যোজনীয়) ক্যাপশন। বর্ণনাত্মক ক্যাপশন সাধারণত ম্যাগাজিনে ব্যবহার করা হয়। এই ক্যাপশনে ছবির বিস্তারিত বর্ণনা থাকে। আর যোজনীয় ক্যাপশন হয় সংক্ষিপ্ত এবং এই ক্যাপশন ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে শুধু তাই বলে না। ছবিতে যা নেই, কিন্তু ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত- সেই গল্পও বলে। আমরা আমাদের আলোচনায় এই এডিটিভ বা যোজনীয় ক্যাপশনের ওপরই জোর দিয়েছি। মাধ্যম হিসেবে ফটোগ্রাফির বিবর্তন হয়েছে। ক্যাপশনও বিবর্তিত হয়েছে- হচ্ছে। কিন্তু ক্যাপশনের মৌলিক জায়গাগুলোতে খুব বেশি হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। শুধু ছবিটা ভালো করতে জানলে এখন আর হয় না। ছবিকে পরিপূর্ণ করতে ভালো ক্যাপশনের গুরুত্ব রয়েছে। একটি বাজে ক্যাপশন একটি মহান আলোকচিত্রকর্মকে ছোট করে দিতে পারে। সুতরাং সেই ক্যাপশনে হাতপাকানো সময়ের দাবি।