চলমান মহামারী নারীকে লিঙ্গ সমতা অর্জন থেকে ২৫ বছর পেছনে নিয়ে যেতে পারে বলে ‘ইউএন ওমেন’ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। মহামারীর প্রভাবে নারীরা গৃহকর্ম এবং সেবাধর্মী কাজে আরো বেশী করে জড়িয়ে পড়ছে।
ইউএন ওমেন এর নির্বাহী উপ-পরিচালক অনিতা ভাটিয়া বলেছেন, গত ২৫ বছরে আমরা যে যে বিষয়ে কাজ করে আসছি তার সবটুকুই ভেস্তে যেতে পারে এই এক বছরে।
তিনি আশঙ্কা করছেন, নারীর শিক্ষা ও কাজের সুযোগগুলো হারিয়ে যেতে পারে। যার ফলে তাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। করোনা মহামারী শুরুর আগেও ধারণা করা হচ্ছিলো অবৈতনিক কাজগুলো নারীরা বেশী করে থাকে। বিশ্বব্যাপী দিনে ১ হাজার ৬ শ কর্মঘণ্টার কোন পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। এর বেশীরভাগই করে নারীরা। আরো সহজ করে বললে পুরুষরা পারিশ্রমিক ছাড়া এক ঘণ্টা কাজ করলে নারীরা করেছে তিন ঘণ্টা। মহামারীর সময়ে পারিশ্রমিকছাড়া এই কর্মঘণ্টা অনেক বেড়েছে।
এ তথ্য উঠে এসেছে ইউএন ওমেন পরিচালিত এক জরিপে। বিশ্বের ৩৮টি দেশে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। এগুলো বেশীরভাগ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ। শিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলোতেও একই চিত্র উঠে এসেছে। অনিতা ভাটিয়া দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, “সবচেয়ে দুঃখজন বিষয় হচ্ছে অনেক অনেক নারী হয়তো মহামারীর পরে কর্মজগতে আর ফিরতে পারবেন না।”
যুক্তরাষ্ট্রে কেবল সেপটেম্বর মাসেই কর্মজগত থেকে ঝরে পড়েছে ৮ লাখ, ৬৫ হাজার নারী। কর্মহীন পুরুষের সংখ্যা যেখানে ২ লাখ।
ইউএন ওমেন সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, শ্রমবাজার থেকে ঝরে পড়ায় নারী কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হবে না বরং তাদের স্বনির্ভরতাও বিঘ্নিত হবে।
মহামারীর সময়ে বিবিসি ওয়ার্ল্ড এর উদ্যোগে নারীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। জানার চেষ্টা করা হয়, মহামারী নারীর কর্মজগতে কতটা প্রভাব ফেলেছে।
জাপানী নারী টেনি ওয়াদা বলেছেন, “আমি প্রতদিনেই কাজের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে রাখি। সেটা পূরণ করি। দিনশেষে দেখা যায় আমার মেয়ে কান্নাকাটি করছে। তার কান্না দেখে আমিও কাঁদছি। এমনকি মহামারীর আগেও জাপানের মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশী অবৈতনিক কাজ করে এসেছে।
টেনির কাছে সময় অতি মূল্যবান জিনিস। মহামারীর আগে বাসা আর স্কুল শিক্ষতা সামলাতে সামলাতে কী রান্না করবে সেই পরিকল্পনা করারও ফুরসত মিলতো না। করোনায় লক ডাউনের সময়ে টেনি ও তার স্বামী দুজনেই হোম অফিস করছেন। কিন্তু দুজনের দিন কাটে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। টেনির স্বামী সকাল সাড়ে নটা থেকে বিকাল ৫টা-৬টা পর্যন্ত অফিসের কাজ করেন। তিনি বাসার একটা রুমে বসে কাজ করার সুযোগ পান কিন্তু টেনির কপালে সেই সুযোগ নেই। কারণ হোম অফিসের পাশাপাশি ঘরে ৮০% কাজ টেনিকেই করতে হয়। যার কোন পারিশ্রমিক নেই। তিন বছরের মেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্বও টেনির ঘাড়ে।
মহামারী শুরুর প্রথম ২-৩ মাস এই পরিস্থিতি সয়ে যেতো। কিন্তু কয়েক মাস পর দেখা গেলো এই ধরণের জীবনযাত্রায় মানসিকভাবে খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বলিভিয়ার কেরকাডো প্রদেশের মেয়ে ডেলিনা লেলাসকোয়েজ। পেশায় কৃষিজীবী। তার দিন শুরু হয় ভোর ৫টায়। কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজগুলোও সেরে নেন ডেলিনা। কিন্তু দুমাস পরপর তার কৃষিপণ্য বিক্রি করতে শহরের বাজারে যেতে হয়। ওই সময়গুলোতে ডেলিনা খুব বিধ্বস্ত অনুভব করতেন। ইদানীং তার মেয়ে তাকে সহযোগিতা করেন।
সমাজের প্রাচীন ধারণা ও চর্চাগুলো যেনো আবারো ফিরে আসছে। ঘরের কাজের পুরো দায় চাপানো হচ্ছে নারীর কাঁধেই। পরিবারের জন্য রোজগার করবে পুরুষ আর নারী ঘরের কাজেই বন্দী থাকবে, বলেন ডেলিনা।
কেনিয়ার নাইরোবিতে বাস করেন নাইজেরিয়ান-আমেরিকান ড. ইজেওমা। তিনি বলেন, তিনি একজন নতুন মা। তার স্বামী অনেক সহযোগিতা করেন। তারা একজন সাহায্যকারীও নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু এ সুযোগ তো সবার হয় না। তবে সাহায্যকারী থাকার পরও ইজেওমাকে দিন শুরু করতে হয় সকাল ৬টা-৭টায়। নারীদের আরাম নিশ্চিত করতে সমাজাই প্রস্তুত না। মাঝে লক ডাউনের সময়ে সাহায্যকারী রাখা সম্ভব হয়নি। ওই অল্প সময়ে ড. ইজেওমা খুব দুর্বিসহ সময় কাটিয়েছেন। তার মনে হতো ঘরের সব কাজ শেষ করে অফিসের কোন কাজ করা সম্ভব না। যদিও পার্টনার হিসেবে তার স্বামী খুব ভালো। বাচ্চার দেখাশোনা, ঘর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়ার সময় আসলে মনে হতো এগুলো যেন নারীদেরই কাজ। এমন পরিস্থিতিতে চরম ঝুকিতে পড়ে যায় নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ।
বিনা পারিশ্রমিকে ঘরের কাজ করে নারী পরিবারকে সহায়তা করেন। তাতে পরিবারে অর্থনৈতিক সাশ্রয় হয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজগুলোকে শ্রম হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। অনিতা ভাটিয়া বলেন, মূল বিষয় হলো এই শ্রমগুলোকে কখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। মহামারী এসে আরো পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বলে কিছু নেই। পুরুষরা সুযোগ পেলেই মহামারীর সময়ে উপার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়তে পারছেন। কিন্তু নারীরা গৃহস্থালী কাজের বোঝা কাঁধ থেকে ফেলে দিয়ে উপার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়তে পারছেন না। ঘরের কাজে বন্দী এ নারীরা উপার্জনের জন্য সময় বের করতেও পারছেন না।
নারীর জন্য এই সঙ্কট কত বড় এবং এর প্রভাব কতখানি সেটা সহজে উপলব্ধি করা যাবে না। সরকার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব না নিলেও এ সঙ্কট থেকে বরে হওয়া সম্ভব না, বলেন অনিতা ভাটিয়া। জাতিসংঘ তাই সদস্য দেশগুলোর সরকার এবং বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবৈতনিক শ্রমের মূল্যায়ন করার আহ্বান জানিয়ে আসছে।