রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছকে সাময়িক বরখাস্তের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন এই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জানেন না। যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিকে একটি মন্ত্রণালয়ের কাজ বলে অভিহিত করেছেন ঠিক তখনই দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরসভার মেয়র, মুজিবনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও সালথা উপজেলা চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শেষোক্তদের সাময়িক বরখাস্তের ঘটনার সঙ্গে সংবাদ হয়েছে। রাজশাহী ও হবিগঞ্জের মেয়রের বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেছেন আদালত।
পূর্বক্ষণে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হয়ে মনিরুল হক্ক সাক্কু বললেন শপথ নিতে পারলে তিনি আওয়ামী লীগ বিজিত মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে যাবেন কুমিল্লার উন্নয়নে তার সহযোগিতা চাওয়ার জন্য। মানে- তিনি মনে হয় সন্দেহ করছেন আদৌ তিনি শপথ গ্রহণ পর্যন্ত টিকে থাকবেন কিনা।
স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই অবস্থা কেন? রাজনীতি কিংবা উন্নয়নে তাদের ক্ষমতা এবং ভূমিকাইবা কি? শাসকদলের প্রতি কি তারা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন? নাকি তারা গণতন্ত্রের জন্যও ক্ষতিকর?
যেসব মেয়র ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের এলাকায় শাসকদলের বাইরের দলগুলোর অবস্থান কি খুবই শক্তিশালী? আলাদাভাবে বিশ্লেষণ না করেও বলা যায়, না তেমন কোনো আলামত দেখা যায় না। রাজশাহীতে শাসকদলের প্রাধান্য একক না হলেও জোটগত অবস্থান চোখে পড়ার মতো। সিলেটে আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন হালে অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর অবস্থান কি সেই তুলনায় খুব নড়বড়ে? দুজনই ভদ্রলোক হিসেবে সিলেটের মানুষের কাছে পরিচিত। সাতকানিয়ায় সাম্প্রদায়িক দলের আস্তানা থাকলেও শাসকদলকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আর ওদের এই মুহূর্তে নেই। সর্বশেষ যেসব প্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে- সেসব এলাকাতেও কমবেশি একই চিত্র দেখা যাবে।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
সুতরাং শুধু রাজনৈতিক কারণে তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার বিষয়টিই কাজ করেছে এমনটা ভাবা একটু কষ্টই হবে। তাহলে কি বগুড়া পৌরসভা মেয়রের জিডি করার কারণকে উল্লেখ করতে হবে? বগুড়া পৌরসভার মেয়র এ কে এম মাহবুবুর রহমানকে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যার হুমকি দেওয়ায় তিনি থানায় জিডি করেছেন। কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাজাবাজার, ফতেহ আলী বাজার ও চাষী বাজারের ইজারাদার। তিনি চাইছেন, বাজারগুলোর ইজারা তিনিই আবার পেয়ে যান। মেয়র তা হতে দেবেন না। সুতরাং তাকে হুমকি-ধমকি এবং শারিরীকভাবে নাজেহাল করা হলো। আর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি জলেশ্বরীতলায় মেয়রের বাসায় গিয়েই ওরা করেছে। বলে দেওয়া হয়েছে পৌরসভা অফিসে যেন আর সে না যায়।
এটা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করে শুধু আশঙ্কাটাই প্রকাশ করা যায়। তাহলে যেসব মেয়র ও জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের অপরাধও কি তেমন? কিন্তু এখানেও হিসাবের গড়মিল হয়। সাময়িক বরখাস্ত আদেশপ্রাপ্তদের কেউ কেউ চেয়ারে স্বল্পকালও বসতে পারেননি। কেউ কেউ আদালতের আদেশ পেয়ে কাজে যোগ দিতে গিয়ে অফিসে তালাও দেখেছেন। তালা খোলার চিন্তা করতে করতে আবারো আদেশ পেয়েছেন সাময়িক বরখাস্তের।
অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ক্ষমতা ও শক্তি কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের না। আমাদের জাতীয় বাজেটের কতভাগ তারা ব্যয় করতে পারেন। স্পষ্ট জবাব হবে জাতীয় বাজেটের ৫০ভাগ তাদের বাস্তবায়ন করার কথা ভাবনায় এলেও বাস্তবতা হচ্ছে তারা মাত্র ৫ শতাংশ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তার মানে উন্নয়নব্যয়সহ টাকাকড়ির কমই তাদের মাধ্যমে ব্যয় হয়। এই ৫ শতাংশ নিয়েই কি কাড়াকাড়ি?
রাজনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- তারা নিজ দলীয় সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে কতটা এগিয়ে যেতে পেরেছেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় স্বাধীনতা দেয় না। সব দলের গঠনতন্ত্রই এমনভাবে প্রণীত যেখানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অবস্থান অনেকটা জি হুজুর মার্কা। জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে অনেকটা ঠুটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করতে হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বার কয়েক এই বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী চুপচাপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনাগুলো কেউ আমলে নেয় না। তাহলে দেখা যেত- এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে সাধারণ মানুষ কতটা নেতিবাচক মনে করছে। এমনকি সাধারণ সম্পাদক যতই বলেন না কেন প্রধানমন্ত্রী কিছুই জানেন না, মানুষ মনে করছে যে দেশে সাধারণ কোনো কাজও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া হয় না, সেখানে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কি প্রধানমন্ত্রীকে ছাড়া হয়েছে?
এই জনপ্রতিনিধিরা রাজনীতি করেন বিধায় এলাকার উন্নয়নকে তাদের পুঁজি করতেই হয়। সেক্ষেত্রে সরকারি দলের সদস্য না হলেও তাদের দ্বারা সরকারি দলের বিরোধিতা করার ক্ষমতা প্রয়োগ সম্ভব হয় না। কারণ তারা জানে সরকারি সহযোগিতা পেতে হলে সরকারকে বিগড়ানো যাবে না। আবার নিজ রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ চিন্তা করলে এলাকার উন্নয়ন সম্ভব হবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিও সরকারের কাছাকাছি থাকার নীতিই অবলম্বন করে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকাকালে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। মেয়র হিসেবে বাড়তি সময়ও কাটিয়েছেন তিনি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর। তিনি বিএনপির সিনিয়ার নেতা হওয়ার পরও সরকার বিরোধী আন্দোলনে মেয়রের ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারেননি। এমনকি দলকেও সংগঠিত করেননি। শুধু নিজের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য। অন্যদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। সুতরাং সরকারের এই সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিকভাবে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা ভেবে দেখা দরকার।
ব্যক্তি ইমেজ কিংবা স্থানীয় কোন্দলের কারণে শাসকদলের বাইরের কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে মূল জায়গায় শাসকদলকে নজর দিতে হবে। সেটা নির্বাচনের আগেই করা প্রয়োজন। যেমন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ভুলগুলো করেছে তার কাছাকাছিই অন্যত্রও হয়। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশেনে প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা কোনটাই নির্বাচনে বিজয়ের জন্য সহায়ক ছিল না। ব্যাপকভাবে প্রচারিত যে, সেখানে দলীয় কোন্দল সরকারি দলের পরাজয়ের কারণ। কিন্তু যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তার পরিবারের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি ভেবে দেখা হয়নি। কুমিল্লায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট অনেক। সেই ভোটগুলোও কেন আওয়ামী লীগ পায়নি সেটাও দেখার বিষয়। ওখানকার খুন খারাবিগুলো নিয়ে জনমনে যে সন্দেহ আছে সেগুলোর দিকেও নজর দেওয়া হয়নি। সংখ্যালঘুদের ওপর যে জুলুম নির্যাতন হয় সেখানে সরকারি দলের ভূমিকা আছে কিনা থাকলে কার বা কাদের ইন্ধন কাজ করে সেসবও বিবেচনায় আনার প্রয়োজন ছিল। এসবদিক চিন্তা না করে বিপুল ভোটে বিজয়ী বিরোধী দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত মেয়রকে যদি কোনঠাসা করার চেষ্টা করা হয় তাহলে রাজনৈতিক তীরটা যে উল্টোপথে চলতে শুরু করবে সেটাও আশা করি বুঝতে অসুবিধা হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)