বেশ কয়েক বছর আগে বৃক্ষ নিধন রক্ষায় কাগুজে সংবাদপত্র পরিহার করে অনলাইন সংবাদপত্র পড়ার একটি বিজ্ঞাপন বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ওই প্রচারণার উদ্গাতা ছিল জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। বেশ ভালোই ছিল ব্যাপারটা। মানুষ হয়তো গভীরভাবে ভেবেছিল। কাগুজে সংবাদপত্র পড়ছি মানে আমিও বৃক্ষ নিধন করে প্রকৃতিকে বিরানভূমি বানাতে সহায়তা করছি।
আমিও অপরাধীদের দলে। অবশ্য এর বিপরীতে কোনো চিন্তা ছিল না তা বলা যায় না। একতরফা গাছ কেটে কারখানায় ঢুকিয়ে বিরামহীনভাবে যেমন কাগজ বানানো হচ্ছে, একইভাবে গাছ গড়েও উঠছে। প্রাকৃতিকভাবেও হচ্ছে, মানুষও লাগাচ্ছে। সে বিজ্ঞাপন মানুষের আর মনে নেই।
যদিও কাগুজে সংবাদপত্রেরর কাটতি কমার বিষয়টি এখন একটি চলমান প্রক্রিয়া। জনপ্রিয় ও বড় দৈনিকগুলোর কাগুজে সংস্করণের কাটতি কমছে, অনলাইনের পাঠকসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তারপরেও মুদ্রণ মাধ্যমের শক্তি, ঐতিহ্য ও প্রকাশ অবকাঠামোর ক্রমোন্নতি বহাল তবিয়তে অন্য এক আভিজাত্য ও অহংকার নিয়ে টিকে আছে। এর উপযোগিতা নিয়েই আছে।
মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। ৮৬৮ সালে চীনে প্রথম বই মুদ্রিত হয়। সেই হিসেবে বারোশ’ বছরের এক বৃক্ষের ডালপালা কিছু শুকিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার টিকে থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এখনও আসেনি। আর কাগজ? তার ইতিহাস দুই হাজার বছর ছুঁই ছুঁই। যতদূর জানা যায়, চীন ১০৫ সালে কাগজ আবিস্কার করে।
এই বিষয়গুলো কোনো গভীর চিন্তা থেকে উৎসারিত নয়। আলোচনার খোরাক হতে পারে এই হিসেবেই লেখা। চিন্তাটির সূত্রপাত গত ১৮ অক্টোবর। ওইদিনের জনকণ্ঠ পত্রিকায় দেশের তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব মোস্তাফা জব্বারের একটি লেখা মুদ্রিত হয়। যেখানে তিনি আমাদের শিক্ষার্থীদের শরীরের ওজনের তুলনায় বেশি ওজনের বই বহনের কষ্টের কথা তুলে ধরেন। দরকারি অনেক তথ্য ও আশাবাদ আছে লেখাটিতে। কিন্তু লেখাটির মধ্যে ব্যবহৃত একটি শব্দ কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
তিনি লিখেছেন, “আমি মনে করি, ডিজিটাল সভ্যতা কাগজের সভ্যতার কবরের ওপরই জন্ম নেবে।” কাগুজে পত্রিকা যেন করুণার হাসি হাসছে তার এই বাক্য পড়ে।’’
হাজার বছরের পুঁথি, কোটি কোটি বই সবই যেন মোস্তফা জব্বারের কল্পিত ‘কবর’ এর উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বলছে, কাগজের মতো এত দীর্ঘজীবি ও দীর্ঘস্থায়ী প্রবীণের কবর খুঁড়তে চাওয়া বোকামি নয় নিছক নোংরামি ও যারপরনাই পাগলামি ও দেউলিয়াপনা। সারা পৃথিবীতেই এখনও উড়ছে কাগজের জয় পতাকা। অজস্র কাগজ পড়ে পড়ে কাগজের কবর রচনাকারী পিতা কিংবা পূর্বপুরুষের নাম পরিচয় ভুলুণ্ঠিতকারীর মতো ভিলেন না হয়ে পারে না।
মোস্তাফা জব্বারের মতো একজন মানুষ কাগজের কবর রচনার মতো বাক্য কীভাবে উচ্চারণ করেন? এখনও বিস্মিত হচ্ছি। কাগজ আর ইলেক্ট্রনিক ডিভাইজের পৃষ্ঠা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা কিংবা দৌড়পাল্লা দিতে চাইনে। এখনও পর্যন্ত দেশের অর্ধেক মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আসেনি এটি যেমন এক সত্য। তার চেয়ে বেশি সত্য এখনও পর্যন্ত কোনো ডিভাইজ আসেনি যেটি কোনো বৈদ্যুতিক শক্তির সহায়তা ছাড়া চলতে পারে। অার অনন্তকাল ধরেই সাধ্যের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে স্বপ্ন ও রুচি।
আজ যে শিক্ষার্থীর বাবার সাধ্য আছে, সে প্রাইমারি স্কুল বয়সেই প্রতি ছয় মাসে একটি ট্যাব বা আইপ্যাড পাল্টাচ্ছে। এই শিশুরা স্বপ্ন দেখে, স্কুলের বইয়ের ভার কমাতে সব বই আইপ্যাডে অ্যাপলিকেশন আকারে ঢুকিয়ে দিলেই তো হয়।
বছরের শুরুতে যেদিন বই বিতরণ করা হয়, সেদিন বইয়ের পরিবর্তে নতুন পাঠ্যশ্রেনির অ্যাপস প্রদান করা হবে। এই স্বপ্ন আমি নিজেও অনেক আগে দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সাধ্যের হিসেবটাও এসঙ্গে করা দরকার। একটি ট্যাবের দাম যদি ১০ হাজার টাকাও হয়, তাহলে সেটি কতদিন ব্যবহার করা যাবে? পড়াশোনা ও লেখালেখি এক ট্যাবেই করা সম্ভব হবে? প্রত্যেকে বিদ্যুৎ সুবিধা নিয়ে চার্জ দিতে পারবে?
চার্জ দেয়া অবস্থায় ব্যবহারের ঝুঁকি সামলাবে কীভাবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমপক্ষে দশ জনের গতিশীল টেকনিশিয়ান নিয়োগ করা কি সম্ভব হবে ডিভাইজগুলো মেরামত করতে? বিষয়গুলো কতদূর ভেবেছেন প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বোঝাই যায়, শহরের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেনীর শিশুদের দুর্ভোগের কথা ভেবেই তিনি আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা জুড়ে একটি দ্রুতগতি সম্পন্ন স্বপ্ন রচনা করেছেন। যে স্বপ্নের বাস্তবায়ন লক্ষমাত্রা ২০১৬ সাল।
তার মানে আগামী বছরই তিনি খুঁড়বেন কাগজ সভ্যতার কবর। শিক্ষার্থীদের ভারী বই থেকে পরিত্রাণের অংক কষেই এই স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। কাগজ কোনো ব্যটারি বা বাইরে থেকে ধার করা শক্তিতে চলে না। কাগজ প্রকৃতিজাত একটি পণ্য যা একসময় বিজ্ঞানের সুমহান আবিস্কার হিসেবে আলোকিত করেছিল পৃথিবী। পাথরের ওপর, গাছের গুড়ির ওপর লেখনির স্থলে একটি বিশেষ পটের ওপর লেখার বা আঁক কাটার সুযোগ করে দিয়েছিল মানব সভ্যতাকে। তারপর কাগজের ওপর ভর করেই এগিয়েছে পৃথিবী।
যুগ থেকে যুগান্তর, কাল থেকে কালান্তরের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে কাগজ। কাগজ আসার পর পাথর বা গাছের গুড়িতে আর লিখতে হয়নি বটে, কিন্তু সেগুলোর কবর তো রচনা করতে চায়নি কেউ। এখনও পাথর পটের যে যেকোনো চিত্র যেকোনো লেখনী দারুণ আদৃত। কাগজের জায়গাটি আরো অনেক বেশি পাকাপোক্ত, তাই কাগজ হারিয়ে যাবে না। মোস্তফা জব্বারের চিন্তার বিরোধীতার চেয়ে দীর্ঘজীবী প্রবীণ কাগজ সভ্যতার মধ্যে মিশে থেকে চিন্তাগুলো এলো, তাই ভাব বিনিময় করলাম মাত্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)