চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

নোবেলের এমন ধৃষ্টতা কি ক্ষমা করা যায়?

সংগীত একটি গুরুমুখী বিদ্যা। এই বিদ্যা অশেষ। সংগীতে মৌলিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও গাইতে গাইতে গায়েন থেকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জনকারী নোবেল বাঙালি জাতির প্রাণের স্পন্দন, প্রাণের সংগীত, আবেগ-অনুভূতির জাতীয় সংগীত নিয়ে যে বেঁফাস কথা বলেছে তাতে বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে।

প্রিন্স মাহমুদের লেখা ও সুরে জেমসের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি অনেক বছর ধরে তুমুল জনপ্রিয়। এত বছরে কোনো রাজনৈতিক নেতা, কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো বুদ্ধিজীবী, কোনো সংগীতবোদ্ধা জেমসের গানটিকে জাতীয় সংগীত করার দাবির মতো ধৃষ্টতা দেখায়নি। সংগীতের সাধক যারা, সংগীত পুরোধা যারা তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এরা কেবলই বাতিঘর, আইডল, আইকন।

Bkash July

এছাড়া কোনো আওয়ামী লীগ নেতা বলেননি গানটি থেকে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দিতে, কোনো বিএনপি নেতা কখনও বলেননি বঙ্গবন্ধুর কথা গানটি থেকে বাদ দিতে। অথচ আমরা এমন এক নষ্ট প্রজন্মের সাথে নষ্ট সময়ের সাথে যাচ্ছি, যেখানে এসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা শুনতে হচ্ছে। এমনকি এ কারণে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে সব ধরনের শ্রোতাদের ভালবাসা পাওয়া গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ আজ প্রশ্নবিদ্ধ নোবেলের কথার জন্য, জেমস-এর মতো সেরা একজন রকস্টার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। 

এই প্রেক্ষাপটে কিছু মানুষ নোবেলের পক্ষ নিয়ে বলছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চায়নি, তার লেখা গান কেন আমাদের জাতীয় সংগীত হবে? সে তো এ দেশের নাগরিক না, তার গান কেন আমাদের জাতীয় সংগীত হবে? ইউটিউবার ইলিয়াছ বলছে, নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে কেন হিন্দুর গান জাতীয় সংগীত হবে? এতেই বুঝা যায়, বিষফোঁড়াটা আসলে কোথায়। মোটকথা হচ্ছে এদেশে রবীন্দ্রনাথকে গিলতে বা হজম করতে এখনও গর্তে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানপন্থীদের গলায় কাঁটা বিঁধছে। সময় আর সুযোগ পেলেই তারা সেটার জানান দিচ্ছে।

Reneta June

এ বিষয়ে পড়াশুনা করে যতটা জানতে পেরেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় রবীন্দ্রনাথের কোনো ভূমিকা না থাকলেও তার নামে রটানো ‌‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক তা রবীন্দ্রনাথ চাননি’, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ নামক বইতেও রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে কিছু লেখা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এমন বেফাঁস তথ্যের কোনো উপযুক্ত ভিত্তি ও নথি নেই। এটা কেবল ছড়িয়েছে। তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বিরোধীতা করেছিলেন, এটা ইতিহাস বলে। সেসময়কার সুধী সমাজের সাথে রবীন্দ্রনাথের উঠাবসা ছিল বলে এটি আনুমানিক ধারণা করা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধীতা করেছিলেন!

রবীন্দ্র জয়ন্তী রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাঁকঝমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হয় এটাও ওদের সহ্য হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বেশিরভাগ সময় ক্ষমতার মসনদে থাকা বিএনপি-জামাত, জাতীয় পার্টি কেন তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জয়ন্তী উদযাপন সংস্কৃতিটা বন্ধ করেনি? রবীন্দ্রনাথ যেখানে আমাদের অন্তরাত্মায় বাস করে সেখান থেকে কি রবীন্দ্রনাথকে উপড়ে ফেলা সম্ভব? কাজী নজরুল ইসলামকে কি আমাদের অন্তরাত্মা থেকে উপড়ে ফেলা সম্ভব? কখনোই সম্ভব নয়। অথচ এরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি-বিপক্ষ শক্তি, হিন্দু- মুসলমান এভাবে ভাগ করে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উত্থান করতে চাইছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে মাঝে মাঝে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি কারা তোলে? এর উত্তর হচ্ছে, একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলামীসহ উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলো এমন উদ্ভট দাবি তোলে। এর সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী দলগুলো সুর মেলায়। এরা বিভিন্ন সময় হিন্দু-মুসলিম বিভাজন তৈরি করে। বাঙালি জাতিস্বত্তাকে হিন্দু-মুসলিম বিতর্কে ভাগ করতে চায়। কিন্তু এরা কি কখনও সফল হয়েছে? হয়নি, সফল কখনো হবেও না। কারণ, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে পঁচাত্তর পরবর্তী সময় এবং বিএনপি-জামায়াত সম্মিলিতভাবে রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির থেকে আলাদা করতে কম চেষ্টা করেনি। এমনকি এখনও জামায়াত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। কিন্তু এতকিছুর পরেও বাঙালির অন্তরাত্মা থেকে তারা কখনও রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।

নোবেল একজন সাম্প্রতিক পাবলিক ফিগার হিসেবে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও মূর্খের মত কথা বলল কেন? পাকিস্তানপন্থী কেউ একথা বললে তবু এতোটা কষ্ট হতো না, কারণ তারা বাঙালি জাতিস্বত্তার প্রকাশ্য শত্রু। কিন্তু যতটুকু জেনেছি, নোবেলের পারিবারিক আবহ তেমনটা নয়। এরপরেও বলতে হয়, সে আসলে পরিবার থেকে প্রকৃত শিক্ষা পায়নি। সে জি-বাংলার এই অনুষ্ঠানের আগে থেকেই ভারতে ছিল। তবুও তার চলাফেরা যে মৌলবাদীদের সঙ্গে ছিল, তার মনমানসিকতা যে তাদের দ্বারা প্রভাবিত এটা সহজেই বুঝা যায়।

নোবেল অর্বাচীনের মতো এমন অমার্জনীয় অপরাধ করে ইতোমধ্যে নিজের ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়েছে। কারণ, তার চাইতেও হাজারগুণ বড় প্রতিভাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে শুধু বাঙালির জাতিসত্ত্বাকে ধারণ করতে না পারার কারণে। সেখানে নোবেল তো মাত্র ক’দিনের পাবলিক ফিগার, এখনও বড় কিছু হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- সে নষ্ট করছে আমাদের শিল্প সাহিত্যের ইতিহাস ঐতিহ্য।

কিন্তু সে অল্প ক’দিনের পাবলিক ফিগার হলেও তার এ কথা ছড়িয়ে পড়েছে, মৌলবাদীরা লুফে নিয়েছে; এতে বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এটা কখনোই ক্ষমা করা যায় না। নোবেলের এমন মন্তব্য অমার্জনীয় অপরাধ। তাই নোবেলকে জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে হবে। এখন সব বিতর্কের সমাধান হবে সে যদি তার ধৃষ্টতার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়, শিল্প সাহিত্যের প্রকৃত সত্ত্বাকে ধারণ করে। এর বিকল্প কিছু নেই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View