ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভূখণ্ডের এই জনপদে কেবল উচ্চ শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে তা’ নয়। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, গণতান্ত্রিক তথা রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা এবং এসব আন্দোলনের সফল পরিণতি দেয়ার ক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এক কথায় অপরিমেয়। তাই অনেকে বলে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ এক অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ সত্ত্বা।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙ্গালীদের কোন কাজে আসবে না এমন আশংকা ব্যক্ত করে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজুদ্দৌলা হলে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। আর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই তিনি দেশটির প্রতি অনাস্থাই জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিব মূলত যুব আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। একই সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আন্দোলন। এটি ছিল সে সময়ের কর্মচারীদের বিভিন্ন বঞ্চনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রমিক কর্মচারীর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে যুবক শেখ মুজিবকে সেদিন তাঁর জীবনের একটি বড় খেশারত দিতে হয়েছিল। তাঁকে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব হারাতে হয়েছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে সেদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর বহিস্কার হওয়াকেই বেছে নিয়ে ছিলেন কিন্তু মাথা নত করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা এই শেখ মুজিবই পরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মন্ত্রী হয়েছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের মূল কারিগর হিসেবে ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনকারী সকল আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছেন, বাংলাদেশের জন্মের আগেই দেশটির রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে জাতির পিতা হয়েছেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী যখন সেই দেশের জাতির পিতা হন তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয় ওই জাতি এবং বিশ্বের কাছে কতটা মর্যাদাবান হয়ে ওঠে তা’ আমরা সহজে উপলব্ধি করতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেরকম গৌরবের অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠান। মর্যাদাবান এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, গবেষক, আমলা প্রভৃতি তৈরি করেছে তা’ নয়; জাতির সামনে যখন যে প্রয়োজন উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র সেখানে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে, জাতিকে পথের দিশা খুঁজে দিয়েছে। এসব কারণে পৃথিবীর যেকোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের জায়গা আলাদা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় মসৃণ অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে তা’ নয়। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে ক্ষমতাসীনেরা সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন-কানুন, বিধি-বিধান দিয়ে অব্যাহতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাত্র এক/দেড় বছরের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আগ্রহে প্রণীত হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি অর্ডার-১৯৭৩। বাংলাদেশের অন্যান্য অসংখ্য আইন-কানুন, আদেশ-নির্দেশ, বিধিমালা সব কিছু নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কিছু না কিছু প্রশ্ন থাকলেও ঢাকা ইউনিভার্সিটি অর্ডার-১৯৭৩ নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি দেশবাসী কারো মনে কোন খেদ রয়েছে বলে আমার জানা নেই। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের আরও ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ’৭৩ এর অর্ডার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। এই অর্ডারের ব্যাত্যয় (deviation) বা প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নিয়ে কখনও কখনও কথা ওঠেনি তা’ বলা যাবে না; তবে ১৯৭৩ এর অর্ডার ভেঙ্গে অন্তত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়েছে এমন নজির পাওয়া খানিকটা কঠিনই হবে। অতীতে সব সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার বা সামরিক সরকার অথবা পুলিশ, মিলিটারি, আমলা সবাই ১৯৭৩ এর অর্ডারের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কর্তৃত্ব করতে গিয়ে একবারের জায়গায় দুইবার ভেবেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে পরিচালিত হবে তার সবকিছুই এই অর্ডারে বিধৃত রয়েছে। এই অর্ডারের আলোকেই প্রয়োজন মাফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে পরিচালনার জন্য বিধি-প্রবিধি, স্ট্যাটুট তৈরি করেছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানারকম খবর প্রকাশিত হচ্ছে এবং নানাজন নানা কথা বলছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবর কিংবা নানা মানুষের কাছে শোনা কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছে বিষয়টি সম্পর্কে আসলেই কি আমরা সম্যক ধারণা রেখে এসব খবরাখবর দিচ্ছি বা কথাবার্তা বলছি? আমি নিজে সিনেট, সিন্ডিকেটের কেউ নই। কিন্তু সিনেট, সিন্ডিকেট বডিগুলোতে আছেন কিংবা ছিলেন তাঁদের বক্তব্য-মন্তব্য পড়েও আমরা কোন দিশা পাচ্ছি না।
সম্প্রতি উপাচার্য প্যানেল গঠন নিয়ে এই যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে তা’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চেয়ারটিকে নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি করছে। এই বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতের ভিন্ন ভিন্ন রায় আমাদেরকে আরও প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় এবং প্রভাবশালী ও দায়িত্বশীল বিবেচিত পত্রিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯.৭.২০১৭ তারিখের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সিনেট সভা নিয়ে ‘সুযোগ থাকলেও সিনেট পূর্ণাঙ্গ করা হয়নি’ এমন শিরোনাম করে খবর ছেপে তাতে লিখেছে- সিনেট পূর্ণাঙ্গ না করে অর্ধেকের কম সদস্য নিয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করায় তা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই খবরটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে – ‘পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন না করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ‘আইনগতভাবে ক্রটিপূর্ণ’ .. … .. । এটা শুধু বর্তমান উপাচার্যের সময়ে পর পর দু’বার ঘটেছে’। এই শিক্ষক পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন না করে উপাচার্য প্যানেল তৈরি করাকে ‘আইনগতভাবে ক্রটিপূর্ণ’ বলেছেন এবং তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে এটা শুধু বর্তমান উপাচার্যের সময়ে ঘটেছে এবং তা’ একবার নয়, দু’বার।
এই খবরটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক যিনি এখনও সিন্ডিকেটের সদস্য তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন যে, ‘সিনেটে ২৫ জনের বাধ্যবাধকতা সিনেট পূর্ণ হওয়ার পর প্রযোজ্য। কারণ অনির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা যে কোন সভার কোরাম পূর্ণ করা সম্ভব’। উল্লেখ্য পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন হয় তখন যখন সেখানে বিভিন্ন ক্যাটেগরি থেকে ১০৫ জন সদস্যের সদস্যপদ কার্যকর থাকে। এ পর্যন্ত কখনও ১০৫ জন সদস্য থেকে পূর্ণ সিনেট গঠিত হয়েছে এমন কোন উদাহরণ রয়েছে বলে আমার জানা নেই; আর তা’ থেকে থাকলেও এক বারের বেশি নয় (১৯৭৪ সালে)। সিনেট সভা বসার জন্য ন্যূনতম ২৫ জন সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন হয় যাকে আমরা কোরাম বলি। কাজেই কোরামের বাধ্যবাধকতা সিনেট পূর্ণ হওয়া অর্থাৎ ১০৫ জন সদস্য বহাল থাকার পর প্রযোজ্য হবে সিন্ডিকেট সদস্যের এমন বক্তব্য বোধ হয় যথার্থ নয়।
পত্রিকাটি একই দিন সম্পাদকীয় ছেপেছে এই বলে যে, ‘খণ্ডিত সিনেটে উপাচার্য প্যানেল’। পত্রিকাটি লিখেছে – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারীরা ৫ জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচনের মতো সিনেট নির্বাচন করার জন্যও নানা ‘ছলচাতুরীর’ আশ্রয় নিয়েছে। এই পত্রিকাটি ১ আগস্ট ৩-কলাম শিরোনাম দিয়ে আবারও একটি খবর ছেপেছে যে- ‘উপাচার্য হতে আবারও আইন লঙ্ঘন’। এই শিরোনামের অধীনে খবরের ইন্ট্রো হচ্ছে – ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট গঠন-প্রক্রিয়া, এতে কারা থাকবেন, কতজন সদস্য হবেন, তা আইনে সুষ্পষ্ট করা আছে। এগুলো মেনে সিনেট গঠন করাটা আইনে ‘বাধ্যতামূলক’ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ক্ষেত্রে আইনের সেই বাধ্যবাধকতা না মেনেই সিনেট অধিবেশনে তিনজনের প্যানেল নির্বাচন করা হয়েছে। এছাড়া সিনেট অধিবেশনের কোরাম পূরণ নিয়েও আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে’। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এসব খবর আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের মনে এক ধরনের বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয় ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সত্যিই কি ১৯৭৩ এর অর্ডার ভঙ্গ করে যাচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ জন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েটদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ২৫ জন প্রতিনিধি, ৫ জন পার্লামেন্ট সদস্য (স্পিকার মনোনয়ন দেন), সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার মনোনীত ৫ জন সরকারী কর্মকর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজের ১৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ জন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতি মনোনীত ৫ জন শিক্ষাবিদ, ডাকসুতে নির্বাচিত ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান (১জন)। এছাড়াও উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য (গণ), কোষাধ্যক্ষ তাঁরা পদাধিকার বলে সিনেটের সদস্য থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে বর্তমানে ভিসি/ প্রো-ভিসিদ্বয়/ট্রেজারার: ৪ জন, শিক্ষক প্রতিনিধি ৩৫ জন, সংসদ সদস্য ৫ জন, সরকারী কর্মকর্তা ৫ জন এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত শিক্ষাবিদ ৫ জন , শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ১ জন– সর্বমোট ৫৫ জন সদস্যের অস্তিত্ব কার্যকর রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার বা স্ট্যাট্যুটে কোথাও বলা নেই যে সিনেট সব সময় পূর্ণ থাকতে হবে এবং সিনেটে ২৫ জন অর্থাৎ কোরামের বাধ্যবাধকতা সিনেট পূর্ণ হওয়ার পর প্রযোজ্য হবে (যেমনটি বলেছেন একজন সিন্ডিকেট সদস্য)।
সিনেট সভা ডাকার ব্যাপারে বাৎসরিক সিনেট সভা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের ইউনিভার্সিটি অর্ডারের ২১(১) ধারায় বলা হয়েছে উপাচার্য একটি দিন নির্ধারণ করে বছরে একটি সভা ডাকবেন যাকে সিনেটের বার্ষিক সভা বলা হবে। উল্লেখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রণয়ন ও পাশের জন্য এমন একটি বাৎসরিক সভা অনুষ্ঠান করতেই হয়। ২১(২) ধারায় বলা হয়েছে “ The Vice-Chancellor may whenever he thinks fit, and shall, upon a requisition in writing signed by not less than thirty members of Senate, convene a special meeting of the Senate.” এখান থেকে বুঝা যায় উপাচার্য যখন সঠিক মনে করবেন তখন তিনি সিনেটের বিশেষ মিটিং ডাকতে পারবেন; নইলে সিনেট সদস্যদের মধ্য থেকে অন্তত: ৩০ জন সদস্য যদি লিখিতভাবে সভা ডাকার অনুরোধ জানিয়ে রিক্যুইজিশন দেন তখন তিনি বিশেষ সভা ডাকতে বাধ্য থাকবেন। একটি হচ্ছে Vice-Chancellor may whenever he thinks fit, অন্যটি হচ্ছে ৩০ জন সদস্য লিখিতভাবে রিক্যুইজিশন দিলে The Vice-Chancellor shall convene a special meeting.
কাজেই পত্রিকাটি যে শিরোনামে লিখলো – ‘উপাচার্য হতে আবারও আইনের লঙ্ঘন’ অথবা ‘সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডাকার জন্য ৩০ জন সদস্যের লিখিত সুপারিশের প্রয়োজন ছিল’ এসব কথা আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডারের সাথে যায় কি? পত্রিকাটি বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডারের ২০(১) ধারা উল্লেখ করে খবরে লিখছে ‘সিনেটে ১০৫ জন সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন আছে মাত্র ৫৫ জন সদস্য’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার অনুযায়ী দেখা যায়, সিনেটে সর্বোচ্চ ১০৫ জন সদস্য থাকার সুযোগ রয়েছে। হ্যাঁ, ১০৫ জন সদস্য থাকলে সেটি পূর্ণ সিনেট হবে। কিন্তু সিনেট বর্তমান, কার্যকর এবং চলমান থাকার জন্য সব সময় ১০৫ জন সদস্য নিয়ে পূর্ণ সিনেট না-ও থাকতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট একটি চলমান বডি। কোরাম হতে যতজন সদস্য প্রয়োজন (২৫ জন) সেই কয়জন সদস্যের সদস্যতা কার্যকর থাকলে এবং ওই ২৫ জন সদস্য সিনেট সভায় উপস্থিত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিলে এটিকে আইনের চোখে continuing, qualifying and active সিনেটের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক যিনি পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন না করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কার্যক্রমকে ‘আইনগতভাবে ক্রটিপূর্ণ’ বলেছেন, একজন সিন্ডিকেট সদস্য সিনেট পূর্ণ হলেই কেবল ২৫ জনের উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা (বা কোরাম)-র কথা বলেছেন, দৈনিকটি সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডাকার জন্য ৩০ জন সদস্যের লিখিত সুপারিশের প্রয়োজন ছিল বলে উল্লেখ করেছে– এই বিষয়গুলো কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটি অর্ডার: ১৯৭৩-এ বর্ণিত ধারা, উপধারা, স্ট্যাটুট কোথাও বিধৃত নেই বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন-কানুন-নিয়মের সাথে এসব কথা মিলে না।
তবে হ্যাঁ, যেখানে সিনেটের পূর্ণ সদস্য সংখ্যা ১০৫ জন থাকার কথা কখনও সেই পূর্ণসংখ্যা সিনেটে থাকছে না কেন? ১৯৭৩ সালে এই আদেশ প্রণীত হওয়ার পর থেকে দেখা যায় একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সিনেট ছিল কেবল ১৯৭৪ সালে। তখন মোট সিনেট মেম্বর ছিলেন ১০২ জন। কিন্তু প্রথম সিনেট সভায় (১০/১২/১৯৭৪) উপস্থিত ছিলেন ৮৫ জন সদস্য। ২৯/০১/১৯৭৬ তারিখের সিনেট সভায়ও উপস্থিত ছিলেন ৬৭ জন। এভাবে আমি অন্তত: ১১টি সিনেট সভার কথা জানি যার কোনটিতেই শতভাগ সদস্য সেসব সিনেট সভায় উপস্থিত থাকেননি। আমার জানা মতে প্রথম সিনেট ছাড়া কোন সময়ে পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠিত হয়নি। ফলে পূর্ণ সদস্য সংখ্যা নিয়ে (১ম সিনেট ছাড়া) কখনও সিনেট সভা বসেওনি। সেদিক থেকে সিনেট সব সময়ই খণ্ডিতই থেকে গেছে কিন্তু সিনেট কার্যক্রম থেমে থাকেনি।
উল্লেখ করা হয়েছে ২৯ জুলাই সিনেট অধিবেশনের মাধ্যমে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ‘আইনকে পাশ কাটাতে’ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে এবং আইনের অপপ্রয়োগ করে বর্তমান উপাচার্যকে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডারের ২০(১) ধারায় সিনেটে ১০৫ জন সদস্য থাকার ‘বাধ্যবাধকতা’ থাকলেও এখন আছে মাত্র ৫৫ জন সদস্য। পত্রিকাটি লিখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডারের ২১(২) ধারা অনুযায়ী সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডাকার জন্য ৩০ জন সদস্যের লিখিত সুপারিশের প্রয়োজন ছিল। বর্তমান সিনেট অধিবেশন ডাকার ক্ষেত্রে এমনটি ছিল না।
অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়ও এই সিনেট অধিবেশন ডাকা এবং উপাচার্য প্যানেল গঠন নিয়ে নানা খবর লেখা হয়েছে। আমি বাসায় নিয়মিত প্রথম আলো পত্রিকা পড়ি। সে হিসেবে প্রথম আলোতে ছাপানো খবরগুলো আমার মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে যে, তাহলে বর্তমান উপাচার্য কি অবৈধভাবে সিনেট ডেকে পুনারায় ভিসি নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করছেন? অথবা, তা’ না হয়ে থাকলে প্রথম আলো কি দায়িত্বশীল এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা থেকে দুরে সরে গিয়ে এ ব্যাপারে এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের আশ্রয় নিয়ে মোটিভেটেড জার্নালিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? এই দু’টো চিন্তার যেকোন একটি আমার মধ্যে উদ্রেক হওয়া এবং তা’ হজম করা আমার জন্য খুবই কঠিন। একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদ নিয়ে এই লেখালেখি এবং ব্যক্তিগতভাবে এই পদের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থী অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের ব্যক্তিগত সততা, ইন্টেগ্রিটি ইত্যাদি সম্পর্কে আমি কেন আমরা অনেকেই ওয়াকেবহাল; অন্যদিকে প্রথম আলোর মতো একটি দায়িত্বশীল পত্রিকার রিপোর্ট। এর কোনটিই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে কিছু তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করে তার ভিত্তিতেই আমার এই লেখা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)