সতেরশ’ ঊননব্বই সালের ৩০ এপ্রিল নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীট-এর ফেডারেল হলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। জেমস ম্যাডিসনকে পরবর্তীতে তিনি লিখেছেন ‘আমাদের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা সবার আগে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য কাজ করবো। আমার দিক থেকে আমি আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করতে পারি যে, এসকল দৃষ্টান্ত সত্য নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’
জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৩২ সালে ভার্জিনিয়ার এক কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভার্জিনিয়ার একজন ভদ্রলোকের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক শিক্ষা, আচার-আচরণ এবং জ্ঞান লাভ করেন।
দুটো বিষয়ে সব সময়ই তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন এবং সেগুলো নিয়ে চর্চা করতেন। আর সেগুলো হলো- সামরিক কৌশল এবং পশ্চিমা সম্প্রসারণ। ১৬ বছর বয়সে তিনি শিনানডোয়াহ্ ভূমি জরিপ কাজে সাহায্য করেন। ১৭৫৪ সালে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে কমিশন লাভ করে প্রথমেই তিনি যে লড়াইতে অংশ নেন তা পরবর্তীতে ফরাসী ও ভারতীয় যুদ্ধে রূপলাভ করে। পরের বছর ওয়াশিংটন কাজ করেন জেনারেল এডওয়ার্ড ব্র্যাডকের সহযোগী হিসেবে। সে সময় একটুর জন্য তিনি রক্ষা পান যদিও চারটি বুলেট তার কোট ছিদ্র করে ফেলেছিল এবং তার আরোহণরত অবস্থায় দুটি ঘোড়া গুলিতে নিহত হয়েছিল।
সতেরশ’ ঊনষাট থেকে আমেরিকার বিপ্লবের আগ পর্যন্ত জর্জ ওয়াশিংটন মাউন্ট ভার্নন- এর আশেপাশে তার জমিজমা দেখাশোনা করেন এবং ভার্জিনিয়া হাউজ অব বারর্জেসেজ-এ কাজ করেন। মার্থা ড্যানরিজ কাস্টিস নামে একজন বিধবাকে বিয়ে করেন জর্জ। পরবর্তীতে তিনি নিজেকে অত্যন্ত ব্যস্ত ও সুখী একটি জীবন যাপন করতে থাকেন। তবে তার অন্যান্য সঙ্গীদের মতো ওয়াশিংটনও নিজেকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিপীড়িত এবং ব্রিটিশ নিয়মনীতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মনে করেন। শাসক দেশের সাথে বিবাদ যতোই চরম আকার ধারণ করতে থাকে, সময়ের সাথে সাথে তিনি ঐ সকল বাধা নিষেধের ব্যাপারে সংযতভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।
সতেরশ’ পঁচাত্তর সালের মে মাসে ফিলাডেলফিয়ায় দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধিদের একজন হিসেবে হলে ওয়াশিংটন ‘কন্টিনেন্টাল আর্মি’-র সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হন। ১৭৭৫ সালের ৩ জুলাই তিনি ম্যাসাচুসেটস-এর কেমব্রিজে তার স্বল্প-প্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন যা ছয় বছর ধরে চলতে থাকে।
শুরুতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশদের হয়রানি করাটাই হবে সবচেয়ে ভালো কৌশল। কংগ্রেসকে তিনি লিখলেন, ‘যে কোন পরিস্থিতিতেই আমাদের কোন সাধারণ পদক্ষেপ এড়িয়ে চলতে হবে অথবা কোন প্রয়োজনীয়তা দ্বারা বাধ্য না হলে কোন কিছুতে কোন ঝুঁকি নেব না।’ পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে দেখা যায় তিনি প্রথম দিকে ধীরগতিতে পিছু হটে আসেন এবং পরে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। অবশেষে, ১৭৮১ সলে ফরাসী মিত্রদের সহায়তা নিয়ে তিনি ইয়র্কটাউনে কর্নওয়ালিসকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন।
ওয়াশিংটন চেয়েছিলেন মাউন্ট ভার্ননে তিনি অবসর গ্রহণ করবেন। তবে অতি শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারলেন যে ‘আর্টিকেল্স অব কনফেডারেশন’- এর অধীনে তার দেশ ভালোভাবে চলছিল না। আর সে কারণেই ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় যে সাংবিধানিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার পেছনে মূল উদ্যোক্তার ভূমিকা তিনিই পালন করেন। নতুন সংবিধান যখন অনুমোদন পায়, ইলেকটোরাল কলেজ সর্বসম্মতভাবে ওয়াশিংটনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে।
আমেরিকার সংবিধানে কংগ্রেসকে নীতিমালা প্রণয়নের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল ওয়াশিংটন তা খর্ব করবার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই প্রেসিডেন্টের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসী বিপ্লবের কারণে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যখন বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়, ওয়াশিংটন তখন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী টমাস জেফারসন অথবা অর্থমন্ত্রী আলেক্সান্ডার হ্যামিলটনের কোনো পরামর্শই পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। বরং, যুক্তরাষ্ট্র আরো শক্তিশালী হওয়া পর্যন্ত তিনি একটি নিরপেক্ষ পন্থা অবলম্বনের ওপর জোর দেন। উল্লেখ্য যে, জেফারসন ছিলেন ফ্রান্সের পক্ষে এবং ও হ্যামিলটন ছিলেন ব্রিটেনের পক্ষে।
যদিও বিষয়টি তার পছন্দ ছিল না- কিন্তু তার প্রথম মেয়াদের শেষ দিকেই দু’টি দল গড়ে উঠছিল। রাজনীতি নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় এবং বুড়িয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হওয়ায় তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বিদায়ী ভাষণে তিনি অতিরিক্ত দলপ্রীতি এবং ভৌগোলিক কারণে ভিন্নতা পরিত্যাগ করতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। বৈদেশিক বিষয়ে তিনি দীর্ঘমেয়াদী মিত্রতার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন।
মাউন্ট ভার্ননে তিন বছরের মতো অবসর জীবন উপভোগ করেন ওয়াশিংটন। ১৭৯৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর গলায় রোগসংক্রমণের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। জাতি কয়েক মাস যাবৎ তার জন্য শোক পালন করে।