আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন ১১ মে। সম্মেলনের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হবে সংগঠনটির নতুন নেতৃত্ব। এর পাশাপাশি সম্মেলন হয়ে যাওয়া তিন শীর্ষ সাংগঠনিক ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মহানগরীর দুই অংশের নেতৃত্বও ঘোষিত হতে যাচ্ছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
নানা আলোচনা এবং চলতি মাসের ২ তারিখে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এ বিষয়ে দেওয়া বক্তব্যের পর ছাত্রলীগকে কথিত সিন্ডিকেট মুক্ত করতে এবং অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভোটে না গিয়ে এবার যে সিলেকশনের মাধ্যমেই নেতা নির্বাচিত হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে স্পস্ট আভাস পাওয়া গেছে। এ জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সম্মেলনের আলোচনা সামনে আসার পরপরই যারা শীর্ষ নেতৃত্বে আসার জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেক নেতার বিরুদ্ধেই আসছে নানা নেতিবাচক অভিযোগ। অন্য সংগঠনের আদর্শ ধারণ করেও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশের গুরুতর অভিযোগও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কারও কারও বিরুদ্ধে। চুলচেড়া বিশ্লেষণের পর অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে তালিকা ছোট হয়ে এসেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব কেমন হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: যারা মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়, যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির, পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার প্রশ্নে যারা আপোষহীন তাদের মধ্য থেকেই আসবে আগামীর নেতৃত্ব।
সংক্ষিপ্ত তালিকায় যারা
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠের রাজনীতি, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, সব মহলে জনপ্রিয়তা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং সাংগঠনিক দক্ষতা সব সমীকরণ মিলিয়ে শেষ মুহুর্তের দৌড়ে শীর্ষে আছেন উত্তরবঙ্গ থেকে বর্তমান কমিটির আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক হোসাইন সাদ্দাম, বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে যুগ্ম সম্পাদক সায়েম খান এবং শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, খুলনা অঞ্চল থেকে সহ-সভাপতি চৈতালি হালদার চৈতি এবং বরিশাল অঞ্চল থেকে সহ-সম্পাদক খাদিমুল বাশার জয়সহ আরও কয়েকজন কয়েকজন।
সূত্র জানায়, মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, সবমহলে গ্রহনযোগ্যতা, সংগঠনের প্রতি আনুগত্য, বাগ্মিতা এবং যুক্তিনির্ভর লেখনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা এ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিয়মীত লেখালেখির কারণে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ইতিবাচক প্রতিবেদনে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সন্তান হোসাইন সাদ্দাম আছেন সংক্ষিপ্ত তালিকায়।
পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালনকারী হোসাইন সাদ্দামের বাবা মো: আমিনুল হক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত মুজিব বাহিনীর একটি দলের ডেপুটি কমান্ডার। বোদা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা হোসাইন সাদ্দাম এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়নরত।
উত্তরবঙ্গ থেকে আরও আলোচনায় আছেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদ কনক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নাট্য ও বিতর্ক বিষয়ক উপ-সম্পাদক কামরুজ্জামান বিশ্বাস জিপু।
নানা হিসেব নিকেশের পর সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠে আসছে গোপালগঞ্জের ছেলে এবং বর্তমান কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক সায়েম খানের নামও। কলেজ জীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় সায়েম খান এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান কমিটির বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে প্রকাশ্যে আওয়াজ তোলা সায়েম খান পড়াশোনা করেছেন সরকারি বাঙলা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান এবং টিভি, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগে।
বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দৌড়ে আছেন শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এবং সহ-সভাপতি আরেফিন সিদ্দিক সুজনও।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সম্মেলনে বলেছিলেন, ছাত্রলীগের এবারের নেতৃত্ব আসবে ‘নতুন মডেলে’। তার সেই ‘নতুন মডেল’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন, এ নিয়ে আলোচনা রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
নতুন মডেলের সমীকরণে নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে আছেন খুলনার মেয়ে চৈতালি হালদার চৈতি। পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য লালনকারী চৈতি বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগের কমিটিতে তিনি ছিলেন সহ-সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পড়া চৈতির ভাবমূর্তি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডেও বেশ উজ্জ্বল বলে আলোচনা আছে।
বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক খাদিমুল বাশার জয়, ত্রান ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক ইয়াজ্ আল রিয়াদ এবং আইন সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন, কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম শামীম (চাঁদপুর), সহ-সভাপতি আদিত্য নন্দী(চট্টগ্রাম) এবং স্কুলছাত্র বিষয়ক উপ-সম্পাদক খাজা খায়ের সুজন(নোয়াখালী)। এছাড়া ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সোহান খানের নামও শোনা যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নেতাদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২৭ বছর। কিন্তু গত কয়েকটি সম্মেলনে সেটি ২৯ বছর করা হয়। এবার বয়স সীমা কতো থাকতে পারে, সে ব্যাপারে এনামুল হক শামীম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা বয়সের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই চূড়ান্ত।
বয়সের ব্যাপারটি নিয়ে সংশয় না কাটায় নির্ধারিত বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দৌড়ঝাপ করছেন কয়েকজন নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন বর্তমান কমিটির দুই সহ-সভাপতি কাজী এনায়েত এবং মেহেদী হাসান রনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট
কেন্দ্রের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে বরাবরই প্রাধান্য থাকে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের। সে হিসেবে এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে আসতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই দুই অঞ্চলের বেশ কয়েকজন।
বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক রানা হামিদ (ফরিদপুর), স্যার এ এফ রহমান হলের সভাপতি হাফিজুর রহমান (ফরিদপুর), কবি জসীম উদদীন হলের সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান (রাজবাড়ি), বিজয় একাত্তর হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হাসান শাহাদাত (শরিয়তপুর), কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক খন্দকার রবিউল ইসলাম রবি (গোপালগঞ্জ) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক সরদার আরিফুল ইসলামের (গোপালগঞ্জ) নাম।
বরিশাল অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক মো. আরিফুজ্জামান আল ইমরান এবং কবি জসীম উদদীন হলের সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে এবার অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিনিধি থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে।
গত বুধবার সম্মেলন নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ জানান, ১১ মে শুক্রবার বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হবে। প্রথমে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, এরপর শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শোক প্রস্তাব, সাংগঠনিক রিপোর্ট, প্রধানমন্ত্রীর দিকনিদের্শনামূলক বক্তৃতার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এরপর সংগঠনের অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে দ্বিতীয় অধিবেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে।