‘তিনি’ কোথায় নেই? আছেন প্রেমে ও বিরহে। আছেন হালকা আড্ডা ও গভীর আলোচনায়। আছেন ট্রেনে–বাসে, ফেরিঘাটে, ভ্যানরিকশা এমনকী বিমানেও। আছেন ড্রইংরুমে ও বারে। আছেন ঠোঙা, প্লেট অথবা বয়ামে। কখনও ‘তিনি’ ঝাল, কখনও মিষ্টি। কখনও সব মিলিয়ে টক–ঝাল–মিষ্টি। কখনও ভাল লাগে কনকনে শীতে, কখনও চাই ঝমঝম বৃষ্টিতে।
হ্যাঁ, ‘তিনি’ চানাচুর। ছোট থেকে বড়, সকলের প্রিয়। স্ন্যাক্স হিসেবে চানাচুরের এই জনপ্রিয়তার মূল কারণটি অবশ্যই তার স্বাদ। বাড়াবাড়ি ধরনের বেশি না খেলে সহজপাচ্য। পেতে ঝামেলা নেই বললেই চলে। ফুটপাথ টু ফাইভস্টার— সর্বত্রই মিলবে। মুড়ি টু ফ্রুট স্যালাড— সবের সঙ্গেই মানানসই।
চানাচুর একপ্রকার ভাজা নাশতা জাতীয় হালকা খাবার। এর অন্য নাম ডালমুট। মুলত এটি ছোলার বা অড়হড় ডালের মিহি গুঁড়া (বেসন) থেকে তৈরি হয়। তবে এতে প্রায়শ চিনাবাদাম, চিঁড়া, সবুজাভ ভাজা মটরশুঁটি ইত্যাদি যোগ করা হয়। বিশেষ করে ভাজা বাদাম চানাচুরের অপরিহার্য উপকরণ। শুকনা, মুচমুচে, স্বাদে ঝাল। দক্ষিণ এশীয়দের কাছে জনপ্রিয় একটি নাস্তা।
গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে খেটে-খাওয়া মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যের চানাচুর সাময়িক ক্ষুধা নিবৃত্তিতে কার্যকর। এটি রুচিকর। মরিচের গুঁড়া ও লবণের কারণে এটি নিজেই ঝাল, তবু প্রায়শ পরিবেশনের আগে পেঁয়াজ কুচি, কাচা মরিচ, সরষের তেল প্রভৃতি, কখনো আদা কুচি বা ধনে পাতা, দিয়ে মাখিয়ে একে আরো সুস্বাদু করা হয়। এছাড়া মুড়ি দিয়ে মাখিয়েও চানাচুর পরিবেশন করা হয়।
চানাচুর তৈরি ও বিক্রি করে হাজার হাজার বেকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে।১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে বড় আকারের কারখানায় চানাচুর উৎপন্ন করা এবং তা প্যাকেটজাত করা শুরু হয়। চানাচুরের কেনাকাটা কেমন? হিসেব বের করা কঠিন। মূলত ছোট ব্যবসায়ীরাই এতে জড়িত। ছোট দোকানদারেরা খুচরোভাবেই চানাচুর বেঁচেন। এখন প্রাণ, স্কায়ার, বিডি ফুড, ওয়েলফুডসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানও চানাচুর তৈরি করে।
এক সময়ে চানাচুর মানে ছিল ‘হাতেগরম’। মেক শিফ্ট ঠোঙাতে সাপ্লাই। ধাপে ধাপে এসেছে প্যাকেটের আধিপত্য। এখন বাজারে রকমারি চানাচুর। যত দিন যাচ্ছে, আসছে নানান রকমফের। চানাচুর প্রস্তুতকারক সংস্থা ও বিক্রেতাদের মতে, বাঙালির স্বাদ পাল্টেছে এবং পাল্টাচ্ছে নিত্যদিন। ক্রেতাদের চাহিদামতোই তারা হরেক কিসিমের চানাচুর তৈরি করছেন। স্বাস্থ্যের কথা খেয়াল রেখে কমানো হচ্ছে মশলার পরিমাণ। জনপ্রিয় চানাচুর প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির মধ্যে ‘মুখরোচক’ অন্যতম। এখন ঝালের চেয়ে টক–ঝাল–মিষ্টি চানাচুরের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষত নারীদের কাছে কাজু, কিশমিশ, নারকেলের কুচি মেশানো চানাচুর জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
আগে প্যাকেটের ঝাঁ–চকচকে জৌলুস ছিল না। ওজন অনুযায়ী কাগজের ঠোঙাতেই দেওয়া হত। কখনও কখনও সাধারণ প্লাস্টিকের প্যাকেটে দেওয়া হয়ছে। এখন পরিবর্তন আনা হচ্ছে প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রেও।
চানাচুরের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বেশ মিল আছে। এক মুঠো চানাচুর হাতের মুঠোয় নিয়ে যদি ভালো করে নিরীক্ষণ করা যায়, তা হলে গণতন্ত্র চিজটি কী, তা খানিকটা মালুম হয়। হয়তো ঝুরিভাজার বগলের তলা দিয়ে ডালমুট উঁকি মারছে, বাদামের গা ঘেঁষে কিসমিস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে, আধখানা কাজুর কোলে নিশ্চিন্তে বসে আছে পাপড়ি, গাঠিয়ার সঙ্গে পাঞ্জা কষতে লেগেছে কাঠিভাজা। মুখে ফেললেও বিচিত্র স্বাদ। টক, ঝাল, মিষ্টি গন্ধেও মিশ্র এক ককটেল। যেন হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সব মিলেজুলে ভাই ভাই। আর ভাগ কি শুধু ধর্মে? কেউ মোটা, কেউ পাতলা, কেউ কালো, কেউ ফর্সা। কেউ বরিশালের তো কেউ নোয়াখালীর। কেউ লম্বা, কেউ খাটো। ভাগ করতে বসলে নানা ক্যাটাগরিতে ভাগাভাগি শেষ হবে না। এত বিভাজন নিয়েও রবি ঠাকুরের ভাষায় এদেশের বিচিত্র জনগণ ‘এক দেহে হল লীন’।
‘লীন’ কথাটা লক্ষ করে দেখলে মালুম হয় যে, লীন মানে ‘বিলীন’ নয়। অর্থাৎ, চানাচুরের কাজু ডালমুট হয়ে যাচ্ছে না, চিনেবাদাম বাদামত্ব বিসর্জন দিয়ে কিসমিসে রূপান্তরিত হয়ে যায়নি বা কাঠিভাজা হয়ে যায়নি পাপড়ি। যে যার ধর্মে থিতু হয়ে আছে। কোনও আহাম্মক যদি মিক্সিতে ফেলে চানাচুরকে পেষাই করে, তা হলেই চানাচুরের সর্বনাশ এবং ধর্মনাশ। তাই গণতন্ত্রে একঢালা বন্দোবস্ত চলে না। কে কী খাবে, কী পরবে, কার উপাসনা করবে, তা তাকেই ঠিক করতে দেওয়া ভালো ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যে সারাক্ষণ বসে থাকে, তাকে যদি কেউ এসে বলে, ‘ওহে, তোমাকে আগামী এক ঘণ্টা একদম চুপচাপ বসে থাকতে হবে,’ তা হলেই তার সমস্যা শুরু। শুরু হয়ে যাবে ওই ব্যক্তির প্রবল উসখুস। তার বাথরুম পাবে, ছাদে যেতে ইচ্ছে করবে, হাঁটুতে ব্যথা হবে। অর্থাৎ, আপনমনে চুপচাপ বসে থাকা এক জিনিস। সেটা নিজের ইচ্ছাধীন। অন্য কেউ যেই কিছু চাপিয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে অনিচ্ছেরা চাগাড় দিয়ে ওঠে। সোজা কথা, হঠাৎ কেউ জবরদস্তি কোনও একটা অনুশাসন চাপিয়ে দিলে মানুষের নানা বিপন্নতা দেখা দেয়।
আমরা পরনিন্দা-পরচর্চা, আড্ডা, কিছু যৌনতা, অপরের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠার কার্যকারণ ফলাফল নিয়ে আলোচনা করে দিন কাটাই। একজন ডিসির যৌনতার ভিডিও নিয়ে মাতোয়ারা হই। বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি কতোটা খারাপ চরিত্রের-সেটা নিয়ে প্রাণপাত করি। আরেকজন ধরা খেলে নিজের সততা নিয়ে গর্ব করি। অবৈধভাবে সম্পদের মালিক হওয়াটা যে কত খারাপ, এ ব্যাপারে নসিহত দিই! কিন্তু একই অভিযোগে নিজে আক্রান্ত হলে বলি: সব ষড়যন্ত্র! নিরপরাধকে ফাঁসানোর চেষ্টা!
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের চরিত্র, বিশেষত তাহার দোষগুলি, ঝোপঝাপের মধ্যেই থাকে এবং পায়ের শব্দ শুনিলেই দৌড় মারিতে চায়, এইজন্যই নিন্দার এত সুখ। আমি নাড়ী-নক্ষত্র জানি, আমার কাছে কিছুই গোপন নাই, নিন্দুকের মুখে এই কথা শুনিলেই বোঝা যায়, সে ব্যক্তি জাত-শিকারি। তুমি তোমার যে অংশটা দেখাইতে চাও না আমি সেইটাকেই তাড়াইয়া ধরিয়াছি। জলের মাছকে আমি ছিপ ফেলিয়া ধরি, আকাশের পাখিকে বাণ মারিয়া পাড়ি, বনের পশুকে জাল পাতিয়া বাঁধি–ইহা কত সুখের! যাহা লুকায় তাহাকে বাহির করা, যাহা পালায় তাহাকে বাঁধা, ইহার জন্য মানুষ কী না করে!’ সত্যিই তাই। আমাদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যই যেন সেই রকম!
তবে পরনিন্দা-পরচর্চার দরকার আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পরনিন্দা পৃথিবীতে এত প্রাচীন এবং এত ব্যাপক যে, সহসা ইহার বিরুদ্ধে একটা যে-সে মত প্রকাশ করা ধৃষ্টতা হইয়া পড়ে। নোনা জল পানের পক্ষে উপযোগী নহে এ কথা শিশুও জানে–কিন্তু যখন দেখি সাত সমুদ্রের জল নুনে পরিপূর্ণ, যখন দেখি এই নোনা জল সমস্ত পৃথিবীকে বেড়িয়া আছে, তখন এ কথা বলিতে কোনো মতেই সাহস হয় না যে, সমুদ্রের জলে নুন না থাকিলেই ভালো হইত। নিশ্চয়ই ভালো হইত না, হয়তো লবণ জলের অভাবে সমস্ত পৃথিবী পচিয়া উঠিত।
তেমনি পরনিন্দা সমাজের কণায় কণায় যদি মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড়ো রকমের অনর্থ ঘটিত। উহা লবণের মতো সমস্ত সংসারকে বিকার হইতে রক্ষা করিতেছে।’
আমরা যে কেবল পরনিন্দা-পরচর্চায় মগ্ন থাকি, তা কিন্তু ঠিক নয়। আমরা নিজেকে মহৎও মনে করি। মহৎ প্রমাণের চেষ্টায় সদাই সচেষ্ট থাকি। এ দেশের মানুষগুলো একটু বিচিত্রও বটে। যাঁরা নিয়মিত ধর্ম করেন তারাও নিয়মিত ঘুষ-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকে। পশুপাখির ক্লেশ নিবারণের জন্য যাঁরা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তারা দিব্যি মাছ-মাংস খান। যাঁরা কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি পোষ্যের জন্য জান-কবুল, তারা যখন মাছ-মাংস খান, তখন ভুলে যান যে, অন্য কোনও পশুকে বধ করেই তার মাংসের জোগান আসছে।
আর সেই জন্যই গণতন্ত্রকে হজম করা বেশ শক্ত ব্যাপার। আর হজম শক্তির অভাবে আমরা নির্বাচনহীন এক আজব গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এ গণতন্ত্র চানাচুরই বটে! মুখরোচক, কিন্তু সারবত্তা নেই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)