বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নির্বাচন হয়েছে অনেক। অনেক মানুষই হয়তো নির্বাচনের বছরটা বলতে পারবেন। তারিখ বলতে পারার মানুষ খুব বেশি হবে না। কিন্তু হুট করে অনেকেই মনে করতে পারবেন নির্বাচনী দুটি তারিখ। তার একটি ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং অন্যটি ৫ জানুয়ারি। অতোটা স্মরণীয় হয়তো হবে না, কিন্তু ২৮ এপ্রিল তরিখটাও একেবারে ফেলনা হচ্ছে না। বিশেষ করে সাংবাদিকদের উপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ছিলো উদ্বেগজনক।
কেউ কেউ এখানে তুলনামূলক সংখ্যাতত্ত্ব আলোচনায় যেতে পারেন। আগের এরকম বা অন্য কোনো ঘটনার তুলনা করে এবার কম বা বেশি সেই কূটতর্কেও যেতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে কর্তব্যরত সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের উপর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে হামলার মতো কূটতর্ককারীরাও গণমাধ্যমের কম শত্রু নন। সরাসরি হামলার কারণ যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে, ঘটনাকে ছোট বা বড় করে দেখাও তেমনই রাজনৈতিক কারণে।
গণমাধ্যম তথা রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে দলীয় রাজনীতির এই প্রক্রিয়া, যেটাকে ঢাকা উত্তরের সদ্য নির্বাচিত মেয়র আনিসুল হক যথার্থভাবেই ‘খেলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং যার অংশ হয়ে যাচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। একসময় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ হলেও, ওই সাংবাদিকদের অনেকেই এখন রাজনৈতিক দলের লেজুড় ছাড়া আর কিছুই নন। মুখে তারা কিছু আদর্শবাদের কথা বললেও অন্তরে আসলে ব্যক্তিস্বার্থ।
একজন রিপোর্টার বা সহ-সম্পাদকের দলীয় কর্মীর মতো আচরণ হয়তো শুধু একটি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু একজন সম্পাদক বা শীর্ষ পর্যায়ের একজন সাংবাদিকের দলীয় নেতার মতো অবস্থান সামগ্রিকভাবে আমাদের সাংবাদিকতার জন্যই ক্ষতির কারণ হয়।

গণমাধ্যমের ভেতরের এ বড় শত্রুর ছোট এক বন্ধুর নাম অযোগ্য সংবাদকর্মী। বেশিরভাগ গণমাধ্যমেই কোনো নিয়োগনীতি না থাকায় দশ চক্রে ভগবানকে ভূত বানিয়ে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন দিয়ে এমন অনেককে গণমাধ্যম কর্মী বানানো হয়েছে যাদের আসলে সেই যোগ্যতা ছিলো না। এতে একদিকে সাংবাদিকতার মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে অযোগ্যরা প্রথমে আবির্ভূত হচ্ছে দলীয় লাঠিয়াল হিসেবে, পরে সাংবাদিক সমাজের নেতাও বনে যাচ্ছেন। যে নেতারা অযোগ্যদের নেতা বানাচ্ছেন সেই সিনিয়র নেতাদের অনেকেরই এক সময়ের সাংবাদিকতার যোগ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন না থাকলেও তারা এমন উত্তরসূরী রেখে যাচ্ছেন যাদের দলবাজি ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা নেই।
একদলীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বের মতো প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তেলতেলে প্রশ্ন আর বিএনপি চেয়ারপার্সনের ব্রিফিংয়ে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করতে চাইলে অন্যদের হয় হৈ হৈ করে উঠা অথবা পরে প্রশ্নকারীকে হেনস্তা করার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য দলবাজ এবং অযোগ্য সংবাদকর্মীরা কতো বড় শত্রু।
এই দলবাজ সাংবাদিকদের এখন চাষবাসের বড় এক জায়গা হয়েছে টেলিভিশনের টক-শো। সত্য-মিথ্যা যা ইচ্ছা তারা টক-শোতে বলে দিচ্ছেন। এক নেত্রীকে আকাশে তুলতে গিয়ে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন অন্য নেত্রীকে। পাতিনেতারা যে ভাষায় মাঠে বক্তৃতা করছেন সেই ভাষা তারা টেলিভিশনে রাতের পর রাত ব্যবহার করছেন। অথচ ওই ব্যক্তিটির যদি সংবাদপত্রে উপসম্পাদকীয় লেখার যোগ্যতা থাকে এবং লিখেন, তা হলে টেলিভিশনের টক-শোর ভাষায় তিনি নিজেই লিখবেন না।
অবশ্য সমস্যা যে শুধু টক-শোজীবীদের তা নয়। নীতি-নৈতিকতা এবং মানের কোনো বালাই না থাকায় প্রতিদিনই ব্যক্তি আক্রমণ টেলিভিশনে সংবাদ হচ্ছে। এমনকি শীর্ষ পর্যায় থেকে ‘গোলাপি’ আর ‘গোপালি’ ডাক শোনার সৌভাগ্যও আমাদের হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে দু’ পক্ষ থেকেই এমন বক্তব্য উচ্চারণ করা হয়। তাই কেউ টেলিভিশনের সংবাদে মানহানি এবং ক্ষতিপূরণের মামলা করেন না। তা না হলে টেলিভিশন মালিকদের এতোদিনে মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণের টাকা গুণতে গুণতে দেউলিয়া হয়ে পথে বসতে হতো।
তবে আমাদের গণমাধ্যমের মালিকানা নিজেও গণমাধ্যমের এক বড় শত্রু। মালিকদের অনেকেই সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টার সঙ্গে নিজের অন্য ব্যবসা স্ফীত করা আর ব্ল্যাকমেইলিং এর উদ্দেশ্য থেকে গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন। অথচ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলেও দেখা যায়, নিজেই মুনাফা অর্জনের এক বড় জায়গা হতে পারে গণমাধ্যম। যে কেউ একটু নাক-কান-চোখ খুললেই বুঝতে পারবেন, যারা গণমাধ্যমকে অন্য ব্যবসার জন্য হাতিয়ার করেননি; বরং গণমাধ্যমটিকে ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করে অর্থ এবং মানবসম্পদের উপযুক্ত বিনিয়োগে গেছেন, তারাই সফল হয়েছেন। যারা ব্ল্যাকমেইলিং এর চেষ্টা করেছেন কিংবা অন্য ব্যবসা রক্ষা বা বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন; তারা সেরা সাংবাদিকদের নিয়েও সফল হতে পারেননি।
বিনিয়োগ করা মালিকের মতোই কিছুটা অন্দরের, কিছুটা বাইরের শত্রু প্রাথমিক বিনিয়োগের পর গণমাধ্যমের লাইফ-লাইন হয়ে থাকা কর্পোরেট দুনিয়া। মাত্র শৈশবে থাকা টেলিভিশনের জন্য এ শত্রু যতো ভয়ংকর, পরিণত বয়সে থাকা প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য তা অতোটা না। তবে পাঠকপ্রিয়তা থাকলে বিজ্ঞাপনদাতাদের চোখ রাঙানির বাধাও যে দূর করা যায় সেটাও প্রমাণ হয়েছে।
গণমাধ্যমের ভেতরের এই শত্রুদের মোকাবেলা করার উপায় উপযুক্ত মালিকানার উপযুক্ত বিনিয়োগে উপযুক্ত বেতন-ভাতার বাছাই করা যোগ্য মানবসম্পদ দিয়ে মানসম্মত গণমাধ্যম গড়ে তোলা। কিন্তু বাইরের যে শত্রু!
সেটা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে নেই। কিন্তু প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম। অন্তত: আমাদের বাস্তবতায় বাইরের সব শত্রুর শক্তির উৎস যেহেতু রাজনীতি, সেটা হোক মাস্তানতন্ত্র কিংবা বেসামরিক বা সামরিক প্রশাসন, তাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সেই পথ ধরে গণতান্ত্রিক মানসিকতাই মুক্ত গণমাধ্যম নিশ্চিত করতে পারে। মুক্ত চিন্তার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম। তবে ব্যস্টিক এবং সামস্টিক সেই ভূমিকাটা দলবাজি হলে স্বাধীন গণমাধ্যম নিশ্চিত হওয়ার সময় আরো পিছিয়ে যেতে পারে।
জাহিদ নেওয়াজ খান: এডিটর, চ্যানেল আই অনলাইন
(ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে উপলক্ষে উইমেন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশের সেমিনারে মূল নিবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত।)