কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনে আটক নেতাদের মুক্তির চেয়ে মানববন্ধন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, এ সময় মানববন্ধনে সংহতি জানাতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককেও লাঞ্ছিত করা হয়।
রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এর আগে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে মানববন্ধন শুরু করে।
এসময় আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের দিকে মাইক ঘুরিয়ে দিয়ে বক্তব্য শুরু করে। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে সর্বপ্রথম এনেক্সে ভবনের সামনের ফুটপাতে প্রায় দুইশ কর্মী ‘গুজবে কান দেবেন না’, ‘ক্যাম্পাস অস্থিতিশীলতা রুখে দাঁড়ান’, ইত্যাদি প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায়। একই সময়ে শহীদ মিনারের উত্তর পাশে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানার নিয়ে দাঁড়ায় অন্তত ১৫ জন।
এর কিছু সময় পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও কয়েকশ’ শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের পাদদেশে মানববন্ধনে দাঁড়ায়। তারা কোটা সংস্কার ও গ্রেপ্তারদের মুক্তির দাবিতে বক্তব্য-স্লোগান দিতে থাকে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনের মুখোমুখি আরেকটি মানববন্ধনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের প্রায় দুইশ’ নেতাকর্মী। তারা শিক্ষকদের দিকে লাউড স্পিকার ঘুরিয়ে বক্তব্য দিতে থাকে।
সোয়া এগারটার সময় বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের একটি বাস এসে শহীদ মিনারের পাশে থামলে বাস থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রী নেমে ছাত্রলীগের মানববন্ধনে যোগ দেয়। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের কিছু ছাত্রীও এতে যোগ দেয়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে বক্তব্য দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। একই সময়ে বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতা আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতা আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন: ‘এখানে এরা জামাত শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এই শিক্ষকরা জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী শিক্ষক, রাজাকার। এখন তাদের চুল দাঁড়ি পেকে গেছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা যুবক ছিলো অথচ এরা যুদ্ধে যায় নাই। এই যে ৬০-৭০ বয়সী শিক্ষকরা এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কই ছিলো?’
তবে সেখানে উপস্থিত চারজন শিক্ষকের মধ্যে তিনজনের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর। আরেকজনের ১৯৬৫ সালে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার মনে আছে। আমি তখন ছোট ছিলাম। আমার পরিবার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে একশ জনের অধিক মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। আর ওরা আমাকে রাজাকার বলছে। আমি যখন চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম তখন শিবির এমন তাণ্ডব চালাতো ছাত্রলীগের উপর। আমি নিজে তাদের রক্ষা করেছি। বিভিন্ন মুভমেন্টে গিয়েছি শিবিরের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আমার পরিবার সবাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতির সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।’
‘ছাত্রলীগ যেটা করছে এটা তাদের আদর্শের সাথে খুবই সাংঘর্ষিক। আামার মনে হয় ছাত্রলীগের এদের মধ্যে সক্রিয় শিবির আছে যারা এই সংগঠনের ঐতিহ্য নষ্ট করতে চায়। শেখ হাসিনার অর্জন ডুবাবে এরা।’
শিক্ষার্থীদের উপর হামলার পেছনে এই প্রশাসনে ইন্ধন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন: ‘আজ থেকে ৫০ বছর পর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লেখা হবে তখন এই প্রশাসকে সবচেয়ে ব্যর্থ প্রশাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।’
অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী মাইক হাতে বিপরীত পাশ থেকে আসা বক্তব্যের নিন্দা জানাতে থাকেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তানভীর হাসান সৈকত বক্তব্য দিতে থাকেন।
রিমান্ডে থাকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মুহম্মদ রাশেদ খানের মা মানববন্ধনে বক্তব্য দেন। সন্তানকে ফেরত চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন: ‘আমার মনিকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমার মনিকে মুক্তি দিন। আমার সন্তান সরকারের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করেনি। আমার মনি কেবল একটা চাকরি চেয়েছে।’
পৌনে ১২টার সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান সমস্বরে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ঘোষণা দেন। জাতীয় সঙ্গীতের পর ছাত্রলীগের এক নেতা আন্দোলনকারীদের মাইকের তার ছিড়ে ফেলেন। এরপর শিক্ষকসহ আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনারের পাদদেশে বসে পড়েন।
পরে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের অংশটিও আরো এগিয়ে এসে মুখোমুখি বসে পড়ে। পাল্টাপাল্টি স্লোগান চলতে থাকে।
উপস্থিত চারজন শিক্ষক বিপরীত পক্ষের সাথে কথা বলতে যান। তবে সেখানে ছাত্রলীগ নেতারা তাদের দালাল, জামাত শিবির বলতে থাকেন। একাধিকজনকে শিক্ষক তানজীম উদ্দিনের দিকে টাকা ছুড়ে মারতেও দেখা যায়।
পরে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের অংশটি রাজু ভাস্কর্যের দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসে। ছাত্রলীগের ওই অংশটিও একই সমান্তরালে তাদের সাথে এগোয়।
বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের সামনে পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিলটি এলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের সামনে এসে ঘিরে দাড়ায়। এসময় তারা আন্দোলনকারীদের মারধোর শুরু করে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। শিক্ষকদের ধাক্কা দেন নেতাকর্মীরা। তারা একপাশে গিয়ে দাঁড়ালে শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছাত্রীরা আতঙ্কে বঙ্গবন্ধু টাওয়ারসহ আশেপাশে আশ্রয় নেয়।
সাংবাদিকরা শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আরেক দফা তাদের দিকে তেড়ে আসে। তবে সাংবাদিকরা ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করে।
এরপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অনেকেই স্থান ত্যাগ করেন। অধ্যাপক ফাহমিদুল হক সাংবাদিকদের সামনে প্রক্টর গোলাম রাব্বানীকে ফোন করে প্রায় দশ মিনিট কথা বলেন।
তবে এ সময় নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চাইলেও প্রক্টর তার কথায় সাড়া না দিয়ে উল্টো এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য শিক্ষকদেরই তিনি দায়ী করেন বলে জানান অধ্যাপক ফাহমিদ।
এরপর পৌনে একটায় প্রক্টরিয়াল টিমের একটি গাড়ি শহীদ মিনারে আসে।
এরপর ১টায় শহীদ মিনারে দুইজন সহকারী প্রক্টর কামরুল আহসান ও সোহেল রানা আসেন। তারাদুই পক্ষকেই সে স্থান ত্যাগ করতে বলেন। তার কিছুক্ষণ পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সে স্থান ত্যাগ করেন।
প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘আমরা সেখানে প্রক্টরিয়াল টিমকে পাঠিয়েছিলাম। দুই পক্ষের সাথেই তারা কথা বলেছে। তবে তারা কেউই তেমন সহায়তা করেনি। এই ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন: ‘ছাত্রলীগের কর্মীরা আগে ছাত্র পরে লীগ। সেখানে ছাত্রলীগের কেউ ছিল না। ছাত্রলীগের কেউ যেয়ে থাকলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গেছে। তবে আমি নিশ্চিত সেখানে ছাত্রলীগের কেউ ছিল না।