ক্যারিয়ার শুরুর সময় আর এখনকার মধ্যে নিজের ভেতর আকাশ-পাতাল পার্থক্য খুঁজে পান তুষার ইমরান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একের পর এক সেঞ্চুরি করে ব্যবধান পরিষ্কার করেছেন তুষার নিজেই। ক্যারিয়ারের এমন স্বর্ণালি সময়ে জাতীয় দল তুষারের কাছে এক আক্ষেপের নাম। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে তুষার স্মরণ করলেন আগের সেই ‘অনভিজ্ঞ তুষার’কে, আবার পরিচয় করালেন এই সময়ের অভিজ্ঞ এক ‘তুষার’কে।
মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সে ওয়ানডে, টেস্ট দলে জায়গা পেয়েছিলেন তুষার। সেটি এখন নিজের কাছে অভিশাপের মতো মনে হয়। কেন, তার ব্যাখ্যাও দিলেন বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে ১০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করা এই ব্যাটসম্যান।
‘টেস্ট খেলে ফেলেছি খেলাটা বোঝার আগেই। প্রথম শ্রেণিতে দুটি সেঞ্চুরি ও ৫০ ওভারের ম্যাচে একটি সেঞ্চুরি করার পরই জাতীয় দলে চলে আসি। কীভাবে টেস্ট খেলতে হয়, বল ছাড়তে হয় তা বুঝে উঠতি পারিনি তখন। অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই চলে। এখনকার অভিজ্ঞতার কথা যদি বলেন তখনকার সঙ্গে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।’
তুষারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার মাত্র ৭ বছরের। ২০০৭ সালের পর থেকে জাতীয় দল থেকে আড়ালে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও এমন কোনো পারফরম্যান্স হচ্ছিল না যে তাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হবে। এমন একটা সময়ে ব্যাটকে ঢাল বানালেন যখন কিনা জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার বয়স এক দশক হয়ে গেছে। তার নামের পাশে এখন ২৮টি সেঞ্চুরি। ধারে কাছে নেই কেউ। সবশেষ ম্যাচে দুই ইনিংসেই করেছেন সেঞ্চুরি। শেষ ৬ ইনিংসে সেঞ্চুরি চারটি!
বয়স ৩০ পেরিয়ে আসার পর দুর্দান্ত ফর্ম, রহস্য কী?
তুষার বলেন, ‘‘আদর্শ ক্রিকেট শুরু হয় ২০-২১ বছর বয়সে। তারপর ‘এ’ দল, একাডেমি দলে খেলে নিজেকে আরও তৈরি করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রবেশ করতে হয়। সেখানে ৬-৭ বছর খেললে সে নিজেকে বুঝতে পারে। খেলতে খেলতে একটা পর্যায়ে চলে আসে। ২৮ থেকে ৩০ বছর বয়সে সে পরিণত হয় এবং ধারাবাহিক হয়। একজন ব্যাটসম্যান যখন তরুণ থাকেন, তখন তার হাতে বেশি শট থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে। লংগার ভার্সনে যেটি সবচেয়ে প্রয়োজন অল্প- শটস খেলবে তবে রান বের হবে। তরুণরা বেশি শটস খেলে রানও করে তবে আউট হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।’
রান করে যাওয়া। বয়সের সঙ্গে তুষারের যে পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি মানসিকতা।
‘আগে ১০০ করলে সবাই অনেক খুশি হয়ে যেত। তারপর মেরে খেলে হয়ত ওই ব্যাটসম্যানটি আউট হয়ে যেত। ত্রিশের কাছাকাছি বয়সে এসে বুঝেছি ১০০ করলে ১৫০ বা ২০০ করার চেষ্টা করতে হবে। যতটা পার্থক্য গড়া যায়। এই পরিবর্তনটা আমার মধ্যে এসেছে।’
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে তুষারের সমসাময়িক অনেক ক্রিকেটারই দুর্দান্ত পারফর্ম করে যাচ্ছেন। যার মধ্যে মাশরাফী অন্যতম। সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে ৩৯ উইকেট নিয়ে দিয়েছেন নতুন বার্তা। তুষারের মনে করেন, ফিট থাকলে বয়স কোনো বাধা নয়, ‘একজন খেলোয়াড় ফিট থাকলে বয়স কোনো ব্যাপার না। শুধু মাশরাফীই না রাজ্জাক, কাপালি, শরিফ সিনিয়রদের মধ্যে আরও কয়েকজন আছে সবাই কম-বেশি অবদান রাখছে। আমাদের নির্বাচক বা অফিসিয়ালদের পছন্দের জায়গা তরুণরা হলেও সিনিয়ররা কষ্ট করেই তাদের জায়গা ধরে রেখেছে।’
ঘরোয়া ক্রিকেটে তুষার মানেই যেন সেঞ্চুরির আরেক নাম। কোথায় গিয়ে থামবেন? তুষার বললেন, সেঞ্চুরি নিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলেও পূর্ণ করতে চান ২০০ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। এ পর্যন্ত খেলেছেন ১৫৬টি। আর ৪৪টি ম্যাচ খেলে বিদায় বলতে চান ক্রিকেটকে।
‘টানা সেঞ্চুরি করে যাওয়ার মজা অন্যরকম। ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ড্রেসিংরুমে বসে খেলা দেখার চেয়ে ২২ গজে রান করাটা বেশি আনন্দের। আমার লক্ষ্য ২০০ ম্যাচ খেলবো। সেঞ্চুরি নিয়ে কোনো টার্গেট নেই। ২০০ ম্যাচ খেলার ইচ্ছা আছে। খেলতে থাকি দেখতে পাবেন আরও সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। প্রতিদিন সেঞ্চুরি সম্ভব না, প্রতিদিন রানও করা যায় না। তবে চেষ্টা থাকবে প্রতি ম্যাচেই যেন কিছু না কিছু অবদান রাখতে পারি। ’
সবার আগে যে প্রসঙ্গ আসা উচিত, সেই প্রসঙ্গ আসল সবার শেষে। জাতীয় দল! তুষার কী ভাবছেন?
‘যদি সুযোগ আসে তবে চেষ্টা করবো। তবে সহজ না। দীর্ঘ সময় পর ফিরে…। একবার যদি সুযোগ এসেই যায় চেষ্টা করবে দলে অবদান রাখতে। মাত্র পাঁচটা টেস্ট খেলেছি। পরিসংখ্যান যদি দেখেন অত ভাল না (গড় ৮.৯০)। যদি সুযোগ পাই চাইব ক্যারিয়ার মেরামত করতে।’
ঘরোয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে যখন আন্তর্জাতিক মঞ্চ রাঙাতে ক্রমেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন তুষার তখন পেছনে তাকিয়ে দেখেন জাতীয় দলে তার সবশেষ ম্যাচ এক দশক আগে! ফেরা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। তিন বছর পর হঠাত আব্দুর রাজ্জাকের প্রত্যাবর্তন কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করে ত্রিশ পেরিয়ে আসা ক্রিকেটারদের। হয়ত তুষারেরও!