কারো কাছে তিনি ছিলেন বাতিঘর, কারো কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস, কিংবা কারো কাছে দারুণ অভিনেতা বা নির্দেশক! সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন সহজ মানুষ, সফল ব্যক্তিত্ব। সবাইকে কাঁদিয়ে ৭৬ বছর বয়সে শুক্রবার ভোরে মারা গেলেন আলী যাকের। মত্যৃর দুদিন আগে তার শরীরে কোভিড-১৯ পাওয়া যায়। যদিও চার বছর ধরে তিনি ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন।
তাঁর প্রয়াণে মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক ও সিনেমা অঙ্গনের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যাঙ্গনে শোকের ছায়া। তিনি ছিলেন তারকাদেরও তারকা। আর তাইতো প্রিয় ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করছেন তারকা থেকে সাধারণ। কেউ কেউ শেয়ার করছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও। সামাজিক মাধ্যমে বলা এই কিংবদন্তীকে নিয়ে স্মৃতিকাতর এমন তারকা নির্মাতা, অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশকদের কথাগুলো থাকলো চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য:
আলী যাকেরের সঙ্গে পাঁচ দশকের সম্পর্ক ছিলো নির্মাতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর। তিনি বলেন, ‘পাঁচ দশকের বন্ধুত্ব, সম্পর্ক যাকের ভাইয়ের সাথে। নাটকের অভিজ্ঞতা, একসাথে দেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। আবার সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোকে বাস্তবায়ন করা, সবই একসাথে মিলে করেছি। মঞ্চে যেরকম দুর্দান্ত সাহসী অভিনেতা ছিলেন, রাস্তায়ও তেমন, মানুষ হিসেবেও ছিলেন সাহসী। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাহসী। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো তো মাইলস্টোন একেকটা। আমাদের গ্যালিলিওর মতো আরেকটি সৃষ্টি খুব কঠিন। এগুলো নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করা যায়, কিন্তু এরকম আর ঘটবে না! তিনি নির্দেশক হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী। সফল মানুষ ছিলেন আলী ভাই, অভিনেতা হিসেবেও সফল। তার স্ত্রী স্বনামধন্য অভিনত্রী, তাঁর কন্যা এবং পুত্র নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। এরকম সফল একজন মানুষের করোনায় চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখের, কষ্টের।’
ক্যারিয়ারে আলী যাকেরের সঙ্গে বেশকিছু কাজ করেছেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকেও দেখা গেছে তাদের। আলী যাকেরের প্রয়াণে তিনি বলেন, ‘আলী যাকের, আমাদের সবার প্রিয় ছোটলু ভাই অন্তীম যাত্রায় কোনো শব্দই আসলে আমার অনুভূতি প্রকাশের জন্য এই মুহূর্তে উপযুক্ত নয়।’ একই সঙ্গে সারা যাকের সহ তাদের সন্তানদের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি।
নির্মাতা অরুণ চৌধুরী বলেন, ‘ছটলু ভাই, মৃত্যু অনিবার্য। তবুও সব মৃত্যুকে মেনে নেয়া কঠিন।’
নাট্যকার মাসুম রেজা লেখেন, ‘আলী যাকের.. একজন শুদ্ধ শিল্পী। শিল্পে ব্রত একজন মানুষ। বিটিভিতে প্যাকেজের আওতায় আমার প্রথম ও দ্বিতীয় নাটক কৈতব ও সেকু সেকান্দার-এর প্রধান চরিত্রের অভিনেতা। টেরিস্টোরিয়াল ইটিভিতে আমার প্রথম সাপ্তাহিক নাটক কূপ নাটকেও তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা। একটি নাটক পাঠের নিমিত্তে তিনি আমার বাড়িতেও এসেছিলেন, অসামান্য এই শিল্পীর সাথে আমার হৃদ্যতা ছিলো। আমার এই গৌরব কোনোদিন ক্ষুণ্ণ হবে না। তিনি মৃত্যুকে জয় করা একজন মানুষ, মৃত্যু তাঁকে মারতে পারবে না কোনোদিন।
নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, খবরটা শোনার পর থেকে স্তব্ধ হয়ে আছি! জানি যাকের ভাইয়ের শরীরটা অনেকদিন ধরেই খারাপ! কিন্তু কিংবদন্তীদের বিদায়ের জন্য আমরা কখনোই প্রস্তুত থাকি না! তিনি যাপন করে গেছেন অর্থবহ একটা জীবন! বহু মানুষের জীবনকেও করে তুলেছেন অর্থবহ! তাঁর অভিনয়, লেখালেখি, ছবি তোলা- সব কিছু নিয়েই তিনি আমাদের সংস্কৃতি জগতের মহীরুহ! আমার এই নাতিদীর্ঘ জীবনেও তাঁর কাছে আছে এক বড় ঋণ। কখনো এটা বলার সুযোগ হয় নাই! আজকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই! নাখালপাড়া থেকে উঠে আসা বাইশ তেইশ বছরের এক যুবক আমি একদিন তাকে ফোন করে বসলাম! একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছি দুবলার চরের উপর! তাঁর সাথে দেখা করতে চাই! তখনো আমি কোথাও কিছু নির্মাণ করি নাই! নওরতন কলোনীর তার রুমটায় দুপুরে আমি যখন ঢুকলাম তখন জানালা দিয়ে উনি বাইরের গাছ দেখছিলেন! এমন আগ্রহ ভরে দেখছিলেন যেনো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু! তারপর আমাকে দেখে তার চেয়েও গুরুত্ব নিয়ে তাকালেন, মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমি কি চাই! তিনি তখন বিশাল তারকা! আমার ডকুমেন্টারিতে,আমি চাইলাম, উনি যেনো ভয়েস ওভার পাঠ করেন! ছোটলু ভাই সেই অখ্যাত আমার কথায় রাজী হলেন! রাজী হলেন কি, উনি এমন করতে লাগলেন মনে হলো আমি উনাকে নির্বাচন করার মাধ্যমে যেনো একটা ফেভার করেছি! তারপর রেকর্ডিংয়ের দিন আধা ঘন্টা আগে চলে গিয়ে আমার সাথে বসলেন রিহার্সেল করতে! আমি যেভাবে চাই সেটা কীভাবে উনি ডেলিভার করবেন সেটা নিয়ে তার যে প্রাণপণ চেষ্টা! কিছুক্ষণ পর পর জানতে চান পরিচালকের মনমতো হচ্ছে কিনা! এই যে বিনয়, এই যে আমার মতো অখ্যাত লোককে পরিচালকের সম্মান দেয়া, এটা আমার আত্মবিশ্বাস তৈরিতে কত বিশাল কাজ করেছে এটা বোঝাতে পারবো না! আত্মবিশ্বাসের চাকা পাংকচার করে দেয়ার কালচার যে দেশে চলে, সেখানে এই কাজটা যে একটা তরুনকে কতটা শক্তিশালী করে তুলতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই বোঝা যায়! যাকের ভাই, আমি জানি আপনি এরকম আরো বহু মানুষের জীবন অর্থবহ করে তুলেছিলেন! আপনার চিরশান্তির জন্য দোয়া করি!
নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল লেখেন, ‘২০২০ সালটা ভয়ানক! আমাদের চারপাশ ধীরে ধীরে খালি হয়ে যাচ্ছে! একজন আলী যাকের এমন একটি প্রজন্মের অভিনেতা এমন একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাদের কারণে অভিনয় শিল্প বা পেশাকে খুব উঁচুমানের বা সম্মানজনক মনে হতো, এখন যেই সম্মান সম্ভবত যাদুঘরে থাকে! ওপারে ভালথাকুন প্রিয় শিল্পী।’
ঢাকাই সিনেমার শীর্ষ অভিনেতা শাকিব খান লেখেন, ‘আলী যাকের এমন একটি নাম, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে যিনি ঋদ্ধ করেছেন। স্বশরীরে তিনি না থাকলেও তাঁর অবদান মুছে যাওয়ার নয়। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
বাংলা ভাষাভাষি সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান লেখেন, আলী যাকের চলে গেলেন, কিন্তু বাংলাদেশের মঞ্চকে রেখে গেলেন আরও অনেক উঁচু করে— অভিনয়ে, সংগঠনে, প্রবর্তনে। দীর্ঘাঙ্গ ছিলেন। শুধু শারীরিক অর্থে নয়, শিল্পের উচ্চতায়ও। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তার অনুপ্রেরণা মঞ্চে এনেছেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় দিয়েছেন তার পূর্ণতা। বিনম্র শ্রদ্ধা, শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা।
অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘গভীর শোক ও শ্রদ্ধা। চলে গেলেন যাকের ভাই। আমরা হারালাম প্রিয় নাট্যজন, একজন প্রাণের মানুষকে।’
নাট্য অভিনেত্রী শাহনাজ খুশী বলেন, ‘কী ভারাক্রান্ত সকাল! হায় রে ২০২০!আমাদের সবার প্রিয় নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধেয় আলী যাকের ভাই আর নাই! কয়েকদিন আগে যাকের ভাইয়ের জন্মদিন ছিল! দীর্ঘদিন হল তিনি অসুস্থ ছিলেন। বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, জন্মদিনটা পার হয়ে গেলে যদি উনার কিছু হয়ে গেলে! যদি আর জন্মদিনে তিনি আমাদের পাশে না থাকেন! কেমন সত্যি হয়ে গেল সে ভাবনা! বিনম্র শ্রদ্ধা,এ শুন্যতা কোন কালে পুরন হবার নয়।হয় না কখনো।’
আলী যাকেরের সঙ্গে একটি ছবি শেয়ার করে অভিনেত্রী অপি করিম লেখেন, গুডবাই আমার গ্যালিলিও। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় নাটক ‘আজ রবিবার’ এর কিছু ছবি শেয়ার করে অভিনেত্রী শাওন লিখেছেন, ‘বড়চাচা’!
জায়েদ খান বলেন, দিনের আলো না ফুটতেই আরেক নক্ষত্রের পতন ঘটলো। মারা গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী লেখেন, আলী যাকের আংকেল! এক বিষণ্ণ কষ্টের সকাল…!
অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা বলেন, ‘আলী যাকের, বাংলাদেশের সত্যিকারের একজন কিংবদন্তী আজ চলে গেলেন। আমার দেখা অত্যন্ত সহজ একজন মানুষ, আমাদের মতো অনেকের বাতিঘর ছিলেন তিনি। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
নির্মাতা মাবরুর রশিদ বান্নাহ বলেন, আলী যাকের স্যারকে আমার জীবনের প্রথম ফিকশনেই আর্টিস্ট হিসেবে পেয়েছিলাম। জীবনের প্রথম ফিকশন থেকেই আমি স্যার এর আশীর্বাদ ধন্য। আমি ভাগ্যবান। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। স্যারকে নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো অমূল্য। এমন একটি সকাল কোনদিনও চাই নি। কিন্তু এই বুকফাটা কষ্টের সকালটা এলো। আসতেই হলো। অনেক কিছু বলতে চাই, বলতে ইচ্ছা করছে কিন্তু লিখতে শক্তি পাচ্ছি না। মহান আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন প্রিয় আলী যাকের স্যার।