ফুটবল বিশ্বে সব পেয়েও যেন কিছুই পাননি ফুটবলের মহাতারকা লিওনেল মেসি। এখনও তাই মেসির অতৃপ্ত আত্মার শান্তি নেই। এক ধরনের হাহাকার তার হৃদয় মাঝে। মেসির ফুটবল জীবনে এখন গোধুলী বেলা।
আর খুব বেশি দিন মাঠে থাকবেন না। ফুটবলকে বিদায় জানাবেন। কিন্তু দেশের জন্য একটি ট্রফি না এনে দিতে পারাটা তার বর্ণিল ফুটবল জীবনে যেনো এক কলংক তিলক হয়ে আছে। সেই তিলক তিনি মুছে ফেলতে চান।
সেই কলংক মোচনের দিনটি আগামীকাল। সকালেই কোপা আমেরিকা ২০২১ প্রতিযোগিতার ফাইনাল। প্রতিপক্ষ আবার চির প্রতিদ্বন্ধী ব্রাজিল। স্বভাবতই আর্জেন্টনা এবং ব্রাজিলের মহারণ। দুদলই এই ট্রফি জয়ে মুখিয়ে আছে।
কিন্তু এই ম্যাচের সব চাপ যেন এসে পড়েছে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসির উপর। চারিদিকে শত সহস্র প্রশ্ন- মেসি কী পারবেন ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে দেশের জন্য এই ট্রফি জয় করতে। আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ যেহেতু ব্রাজিল সেহেতু বিষয়টি অত সহজ না। মাঠের লড়াই-এ ব্রাজিলকে হারিয়েই কেবল মেসিকে সাফল্য মুঠোবন্দী করতে হবে।

আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার কিনা সে মূল্যায়নের চূড়ান্ত সময় আসেনি। তবে অভাবনীয় দক্ষতায় যে কোনো ম্যাচকে যে তিনি দ্রুত বদলে দিতে পারেন সে প্রমাণ রেখেছেন অসংখ্যবার। মেসির ফুটবল শৈলি নিয়ে তাই ঘোর শত্রু বা সমালোচকও মাথা নত করতে বাধ্য।
ফুটবলে বিরল এক প্রতিভা হিসেবেই এসেছিলেন। ফুটবলে জীবনে মেসি পেয়েছেনও অনেককিছুই। বিশেষ করে ক্লাব পর্যায়ে তার সাফল্য সীমাহীন। গুচ্ছ গুচ্ছ সাফল্য। সাফল্যের যেন শেষ নেই। কিন্তু দেশের জন্য তিনি এখনও ট্রফি শূন্য। এ যেন এক বেদনাময় কাব্য।
এ কারণে বদনাম তার পিছু ছাড়েনি। নিন্দুকেরা বরাবরই এই খোটা তাকে দিয়ে থাকেন। এই অতৃপ্তির কথা মেসি নিজেই বহুবার বলেছেন। এবারও বলেছেন, ‘কিছুই চান না, কোপার ফাইনাল ট্রফিটা জেতাই তার মূল লক্ষ্য। এটি পেলেই তিনি খুশি।’
আসলেই মেসির অতৃপ্তির শেষ নেই। প্রতিবারই তার হাত থেকে ছুটে গেছে বিশ্বকাপ, কোপা কাপের ট্রফি। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের কথাই ধরা যাক। সেবার বিশ্বকাপ ফুটবলে দুর্দান্ত শক্তি প্রদর্শন করে ফাইনালে উঠে আসে মেসির আর্জেন্টিনা। স্বপ্নপূরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু ১৪ জুলাই ভালো খেলেও ফাইনালে হারতে হয় জার্মানের কাছে। এদিন ব্রাজিলের মারকানা স্টেডিয়ামে খেলার অতিরিক্ত সময়ের ১১৩ মিনিটে জার্মানির বদলি খেলোয়াড় মারিও গোটসে আচমকা গোল করে মেসিকে হতাশায় ডুবিয়ে দেন। ১৪ সালে বিশ্বকাপ জিতলে পারলে মেসির জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা থাকতো বলে মনে হয় না।
একইভাবে পরপর দুবার কোপাকাপের ট্রফি হাত ছাড়া হয়ে যায় শুধুমাত্র ভাগ্য সহায়তা না করার কারণে। ২০১৫ সালে কোপা কাপের ট্রফি হাত ছাড়া হয়ে যায় মেসির টাইব্রেকারের লড়াই-এ । ৪ জুলাই গোল শূন্য ম্যাচে চিলির কাছে ট্রাইব্রেকারে (৪-১) হেরে ট্রফি ছাড়া ফিরতে হয়।
পরের বছর ২০১৬ সালের ২৭ জুন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেমিফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলার পরও ফাইনালে সেই একইভাবে চিলির কাছে টাইব্রেকারে (৪-২) হারতে হয়। মেসির দুঃখময় দিনের তালিকা যেনো আরও দীর্ঘ হয়।
বিষন্ন বদনেই ফিরতে হয় মেসিকে। মেসির কোপা ভাগ্য যে খুবই খারাপ তা বলতে দ্বিধা নেই। মেসির অধিনায়কত্বেই আর্জেন্টিনা ২০০৭ সালে কোপা কাপের ফাইনালে উঠে। প্রতিপক্ষ হিসেবে আসে ব্রাজিল। ১৫ জুলাই ভেনেজুয়েলাতে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে ব্রাজিল ৩-০ গোলে জয়লাভ করে চ্যাম্পিয়ন হয়।
ব্রাজিলের পক্ষে গোল করেন জুলিও বাপ্টিস্তা, রবার্তো আয়ালা এবং ডেনি আলভেস। গোল শূন্য থাকেন মেসি। দেশের পক্ষে একটি বিশ্বকাপ এবং তিনটি কোপা কাপের ফাইনালসহ মোট যে চারটি ম্যাচে পরাজিত হয়ে তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে সেই ম্যাচে তিনি কোনো গোল করতে পারেননি।
আন্তর্জাতিক ম্যাচে মেসির অভিষেক ঘটে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট হাঙ্গেরির বিপক্ষে। সে ম্যাচে ২-১ গোলে জয় লাভ করে আর্জেন্টিনা। তবে তার পা থেকে গোল আসে আরও পরে। ২০০৬ সালে দেশের পক্ষে ৬ নম্বর ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তিনি প্রথম গোল পান। ক্রোয়েশিয়ার সাথে এই প্রীতিম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডে।
খেলায় আর্জেন্টিনা ৩-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হলেও ১৯ নম্বর জার্সি গায়ে মেসি উদ্ভাসিত হন অন্যভাবে। তেভেজের দেওয়া গোলে এসিস্ট করেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় গোল করেন যথারীতি রাইট উইং থেকে বল নিয়ে ডিবক্সের সামনে থেকে নিজস্ব স্টাইলে গোল করেন।
অথচ ক্লাব ফুটবলে মেসি কী করে দেখাননি। ফুটবলে জগতের অনেক বিস্ময় তিনি উপহার দিয়েছেন। ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর মাত্র ১৬ বছর বয়সে এক নতুন ইতিহাস রচনা করে বার্সালোনার পক্ষে তার অভিষেক ঘটে। প্রথম ম্যাচ খেলেন পর্তোর বিপক্ষে। ক্লাবের পক্ষে মেসির সাফল্য নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো।
কারণ এখানে তিনি এতেটাই আলোকময় তা বলে শেষ করবার নয়। বার্সেলোনার হয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন লীগসহ মোট ১৭টি ফাইনালে অংশগ্রহণ করেছেন। বার্সালোনার পক্ষে ৩৪টি টাইটেল জিতেছেন তিনি। ক্লাসিকোর লড়াই-এ তার গোলসংখ্যা ২৬। লা লীগাতে তার হ্যাট্রিক সংখ্যা ৩৬। বার্সালোনার পক্ষে তার মোট গোলের সংখ্যা ৭৭৮। এরমধ্যে অফিসিয়াল গোল ৬৭২।
মেসি এ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে মোট ৭৭টি গোল করেছেন, খেলেছেন ১৪৯টি ম্যাচ। আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেন হিসেবে মেসি অবিভূত হন ২০১১ সালে কলকাতার মাঠে। কলকাতার সল্ট লেকে ভেনেজুয়েলার সাথে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ হয়। সেই ম্যাচে নেৃতত্ব দেন মেসি।
বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি প্রথম গোল করেন সার্বিয়ার বিপক্ষে। গ্রুপের দ্বিতীয় খেলায় রডরিগেজের বদলি হিসেবে নামেন ৭৫ মিনিটে । মাঠের নামার তিন মিনিটের মধ্যেই হার্নান ক্রেসপোর করা গোলে এসিস্ট করেন। এরপর ৮৮ মিনিটের সময় দলের পক্ষে ষষ্ঠ গোল করেন। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২০১২ সালে প্রথম হ্যাট্রিক করেন সুইজারল্যান্ডের সাথে এক প্রীতিম্যাচে।
ব্রাজিলের বিপক্ষে তার একটা হ্যাট্রিকও আছে ২০১২ সালে আমেরিকাতে একটি প্রীতিম্যাচ হয়। সে ম্যাচে ৪-৩ গোলে ব্রাজিলকে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি হ্যাট্রিক করেন। এরপর ২০১৮ সালে হ্যাট্রিক করেন বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ইকুয়েডরের বিপক্ষে। মোট হ্যাটিকের সংখ্যা ৬। বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত মেসির গোল সংখ্যা ৬টি।
এবারের কোপা কাপের শুরু থেকেই মেসিকে দেখা গেছে ভীষণরকম লড়াকু মেজাজ নিয়ে খেলতে। প্রতিটি ম্যাচেই অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় মনপ্রাণ উজাড় করে খেলেছেন। দুর্দান্ত গোলও উপহার দিয়েছেন।
কিন্তু আগামীকাল যা হবে সেটাই ইতিহাস। কাল আর্জেন্টিনা জিতলে মেসির সারাজীবনের একটি স্বপ্নপূরণ হবে। বেদনাময় কাব্যের অবসান হবে। আর আর্জেন্টিনা হেরে গেলে মেসিকে অতৃপ্তই থাকতে হবে। বেদনার ভার ফের বইতে হবে। দেখা যাক মেসি আর নেইমারের লড়াইটা কেমন হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)