গাইবান্ধার ঘটনায় পুলিশ জড়িত ছিল বলে বিচার বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। শাহবাগে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায়ও ৯ পুলিশকে অভিযুক্ত করেছে পুলিশেরই তদন্ত দল। পুলিশ এরকম অপরাধে জড়ায় কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পুলিশের এমন আচরণের পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। এক. ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল এর ভিত্তিতেই চলছে এখনকার পুলিশরা। সেটা সেই ঔপনিবেশিক আমলের আইন। এবং এই আইন চলছে কোনো রকম পরিবর্তন সাধন না করেই। আইনটিতে সুশাসনের কোনো অবস্থান নেই। তখনকার সময়ে সরকারব্যবস্থা ছিল নিস্পেষনমূলক ফলে পুলিশি আইনও তৈরি হয়েছিলো সেভাবেই। সেই অবস্থাই চলছে এখনও।
দুই. পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সুশাসনের কোনো ব্যবহার নেই। সেখানে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক লেনদেন হয়, সেটা সবাই জানে। থাকে আঞ্চলিকতাপ্রীতিও। ফলে পুলিশের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার মতো মানসিকতা থাকে না। তাদেরও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা হয়ে উঠে না।
তিন. শাস্তির বিধান না থাকাও এই ধরনের অপরাধের একটি বড় কারণ। পুলিশ কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তির হয় খুবই কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাস্তি বলতে শুধু ক্লোজ করা হয়। মানে সে ডিউটি করবে না, কিন্তু বেতন ঠিকই পাবে। সেটা নিশ্চয়ই কোনো সমাধান নয়। অপরাধীদের শাস্তি দিলে এই ধরনের অপরাধের প্রবণতা আরো কম হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
পুলিশের সাবেক আইজি আওলাদ হোসেন মিঞা অবশ্য মনে করেন, বাহিনীর একজনের সমস্যা হলো তো আর সেটা পুরো বাহিনীর দোষ হয়ে যায় না। বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য এমন, সবাই নয় নিশ্চয়। তাহলে অল্প কিছু মানুষের জন্য পুরো বাহিনীর কেন দোষ হবে? তবে যারা এমনটা করে সবাই যে ইচ্ছে করে করে ব্যাপারটা সেটাও না। কখনও কখনও যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে এরকম ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তবে এমনটা যে করে পুরো দোষ তারই, সমগ্র বাহিনীর নয়।
বারবারই এমন নানান ধরনের অপরাধে সংযুক্ত হয়ে পড়ছে পুলিশের নানান সদস্য। তাহলে সমাধানের পথ কি?
জবাবে সাবেক আইজি আওলাদ হোসেন মিঞা বলেন, শাস্তির ব্যবস্থা থাকাটা জরুরি। যারা অপরাধ করছে তাদের শাস্তি হলে অন্যরা সেই ধরনের অপরাধ করতে ভয় পাবে। সেটা তাদের কারাদণ্ডের আদেশও হতে পারে। তাছাড়া পুলিশদের ট্রেনিং আরো বেশি জোরদার করতে হবে। জেলায় জেলায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রেনিংটা এত গভীরভাবে দিতে হবে যেন কেউ কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মানসিকতা না রাখে।
শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান অবশ্য সমাধান হিসেবে ২০০৭ সালের পুলিশ অধ্যাদেশ কার্যকর করারই কথা বললেন, যেটা কিনা ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। নিষ্পেশনমূলক অত্যাচারের মানসিকতা থেকে পুলিশকে আবার ফিরে আসতে হবে। সেই সব নির্দেশনাই রয়েছে এই অধ্যাদেশে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট করতে হবে শাস্তির জায়গা।
পুলিশকে নিষ্পেশনমূলক মানসিকতা থেকে সরাতে রাষ্ট্রকেও খানিকটা মানবিক হতে হবে। যেমন কেউ হয়তো মিছিল করছে সেখানে রাষ্ট্র চড়াও হবে না। পুলিশও তাহলে অপরাধমূলক মানসিকতা থেকে খানিকটা সরে আসবে।
এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন হবে। তারাই বদলি, নিয়োগ ও পদোন্নতি দিবে। আর সেই পুলিশ কমিশনে অনেক বিশিষ্ট জন থাকবে ফলে এসব ক্ষেত্রে যেকোন তদবির ফৌজদারী অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। সেসব কার্যকর হলেই পুলিশ হয়ে উঠবে আরো বেশি জনবান্ধব।