পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার অনুমোদনহীন ক্যান্টিনে গরুর মাংসের তেহারি রান্না এবং তা সনাতন ধর্মালম্বী শিক্ষার্থীদের বিতরণের অভিযোগের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ পাচ্ছেন, আর ক্যান্টিন মালিক বলছেন কেবল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তিনি তা তৈরি করেছিলেন। গরুর মাংস রান্না করা যাবে না, এ জন্য তাকে কেউ নির্দেশনাও দেয়নি বা কেউ নিষেধও করেনি বলে দাবি করেছেন। ‘বাড়তি লাভের আশায় আলাদাভাবে বিক্রির জন্য’ তা তৈরি করেছিলেন তিনি।
‘পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের মানুষ চারুকলায় ঘুরতে আসে, যাদের অনেকেই গরুর মাংস পছন্দ করে। তাদের কথা মাথায় রেখেই কিছু বাড়তি লাভের আশায় আমি গরুর মাংসের তেহারি তৈরি করি, ক্যান্টিনের বাইরে আলাদা স্টল করে বিক্রি করার জন্য। আমাকে কেউ নির্দেশনাও দেয়নি, বা গরুর মাংস রান্না নিষিদ্ধ এমন কথাও আমাকে কেউ বলেনি’ চ্যানেল আই অনলাইনকে এ কথা বলেন ক্যান্টিন মালিক জাকির।
এ ঘটনায় জামায়াত-হেফাজত চক্রের ষড়যন্ত্র জড়িত থাকার দিকে ইঙ্গিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, কোন সন্দেহই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ক্যান্টিন মালিককে দিয়ে এটা কেউ করালো কিনা বা চারুকলার ভেতরের কেউ এর সঙ্গে জড়িত কিনা তা সবই খতিয়ে দেখা হবে। যদিও ঘটনার পর তিনদিন পার হয়ে গেলেও এখনও গঠিত হয়নি তদন্ত কমিটি।
এদিকে যার নির্দেশে ক্যান্টিন থেকে গরুর মাংসের তেহারি শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়, বৈশাখ উদযাপণ কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক এবং ছাত্রলীগ নেতা সাগর হোসেন সোহাগ সেই ঘটনার জন্য ‘ভুল স্বীকার করে’ দু:খ প্রকাশ করেছেন। ঘটনার দিন দুপুরে চারুকলার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ সভায় তিনি দু:খ প্রকাশ করেছেন বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন ওই বৈঠকে উপস্থিত একজন।
নিজে ওই তেহারি খেয়ে কেনো সনাতন ধর্মালম্বীদের তা খেতে দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সোহাগ এর আগে সাংবাদিকদরে বলেছিলেন, ‘সারারাত কাজ করে ক্লান্ত থাকায় তেহারিতে গরুর মাংস ছিল কিনা বিষয়টি ওইভাবে খেয়াল করা হয়নি।’
চারুকলায় গরুর মাংস নিষিদ্ধ কিনা?
দেশব্যাপী বিতর্ক তৈরি হওয়া বিষয়টি অনুসন্ধান করে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে চ্যানেল আই অনলাইন নিশ্চিত হয়েছে যে চারুকলায় গরুর মাংস কখনও নিষিদ্ধ ছিল না, এখনও নেই। গরুর মাংসের দাম চড়া থাকায় ক্যান্টিন পরিচালকরা তা সাধারণ খাদ্য তালিকায় রাখতেন না। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ অর্ডার করলে ক্যান্টিন থেকে গরুর মাংস রান্না করা হতো। বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী অন্য পশুর মাংসও রান্নার চল আছে। গরুর মাংস আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ না থাকার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন চারুকলার ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।
‘মাঝে মধ্যে আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ ওই ক্যান্টিন থেকে খাবার এনে খান, আমিও খেয়েছি কখনও কখনও। কিন্তু তার মধ্যে কখনও গরুর মাংস দেখিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই চারুকলায় গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা হয়নি।’
কার কাছে বাকি, কত বাকি?
‘কয়েকজনের কাছে ৬০-৭০ হাজার টাকা বাকি থাকায় তা না দেওয়ার চিন্তা থেকেই এমন ভাঙচুর হয়েছে’ ঘটনার দিন ক্যান্টিন মালিক এমন দাবি করলেও চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি জানিয়েছেন বাকির পরিমাণ আসলে লাখ টাকার বেশি। তবে এ টাকা কোন ব্যক্তি বিশেষের কাছে পাওনা নয়, মঙ্গলশোভাযাত্রা উদযাপণ কমিটির কাছে পাওনা।
এ বিষয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বৈশাখ উদযাপণ কমিটির একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছরই আসলে মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রস্তুতির সময় এমন বাকি হয়। তা শুধু ক্যান্টিনেই নয় কর্কশিটসহ বিভিন্ন দোকানেই থাকে। যা শোভাযাত্রা শেষ হওয়ার পরে উদযাপণ কমিটি একটি মিটিং করে আয়-ব্যয় সমন্বয় করে তা পরিশোধ করে থাকেন।
এদিকে যার বিরুদ্ধে ৬০-৭০ হাজার টাকা বাকি খাওয়ার অভিযোগ সেই সোহাগ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, ‘আমি কোনদিন বাকি খেয়েছি বা আমার কাছে টাকা পাওনা রয়েছে, তা প্রমাণ করতে পারলে আমি ক্যাম্পাস ছেড়ে দেবো।’
বিভিন্ন সময় খেয়ে অনেকের কম দেওয়ার কথা জানালেও সুনির্দিষ্টভাবে কার কাছে কত বাকি সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি ক্যান্টিন পরিচালক জাকির।
তেহারি উত্তেজনা, ভাঙচুর ও ক্যান্টিন মালিককে মারধর
মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন শেষে শিক্ষার্থীদের খাওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যান্টিন থেকে বয়দের দিয়ে ভ্যানে করে প্রায় দুই শ’ প্যাকেট খাবার পাঠান আয়োজক কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক এবং ছাত্রলীগ নেতা সাগর হোসেন সোহাগ। কিন্তু প্যাকেটের তেহারি যে গো-মাংসের তৈরি এটা শিক্ষার্থীদের বলা হয়নি। সবাই মিলে খাওয়ার এক পর্যায়ে সনাতন ধর্মালম্বী কিছু শিক্ষার্থীর প্রথমে সন্দেহ হলে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিশ্চিত হয় যে তা ছিল গরুর মাংস।তেহারির মধ্যে গরুর মাংস থাকায় সতাতন ধর্মালম্বী কিছু শিক্ষার্থী উত্তেজিত হয়ে ক্যান্টিনে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে তারা ক্যান্টিন মালিককে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ‘সদুত্তর দিতে না পারায়’ উত্তেজিত কয়েকজন শিক্ষার্থী খাবার ছুড়ে ফেলে ক্যান্টিনে ভাঙচুর চালায় এবং ক্যান্টিন মালিক জাকিরকে মারধর করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে পুরো চারুকলায় বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুর আগে দ্বিমত, একটি অংশের ‘বর্জন’
উত্তেজনা ও ভাঙচুরের একপর্যায়ে সনাতন ধর্মালম্বী শিক্ষার্থীরা চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নিসার হোসেনের কাছে গোমাংস বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের তৎক্ষণাৎ বিচার দাবি করেন। ততক্ষণে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যা অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরসহ অন্যান্য অতিথিরা এসে উপস্থিত হন। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রার পর বিষয়টির সুরাহার আশ্বাস দিয়ে ডিন শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন সবাইকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে। কিন্তু তারপরেও অনেক শিক্ষার্থী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়নি।
ডিন বিষয়টি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের বলেছি, তোমাদের হাতে পায়ে ধরি। আগে মঙ্গল শোভাযাত্রাটা শেষ হোক তারপরে তোমাদের বিষয়টি মীমাংসা করা হবে। তবুও অনেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়নি।’
ওইসময় প্রতিবাদকারী এক শিক্ষার্থী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ এঘটনার জেরে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়নি।’
জামায়াত-হেফাজত চক্রের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গরুর মাংস বিতরণের ঘটনাটিকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের পায়তারা’ হিসেবে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখনও তদন্ত না হলেও সেদিকেই ইঙ্গিত তাদের।
চারুকলার ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের একটা ষড়যন্ত্র হতে পারে। ভেতর থেকে বা বাইরে থেকে। এরই মধ্যে চারুকলার ভেতরেই এমন একটি ঘটনা ঘটলো।’
‘ঘটনাটি কেন ঘটলো, কারা ঘটালো বা কীভাবে ঘটল সেটা তদন্ত করে দেখা হবে।’
এ ঘটনায় জামায়াত-হেফাজত চক্রের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে মন্তব্য করে কয়েকজন শিক্ষকের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আসা জগন্নাথ হল কেন্দ্রিক একাধিক শিক্ষক প্রকাশ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্যান্য সময়ে খুব একটা দেখা না গেলেও শোভাযাত্রা শুরুর আগে আগে তাদের বেশ তৎপর দেখা যায়। তাই কোন সন্দেহই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া ক্যান্টিন মালিককে দিয়ে এটা কেউ করালো কিনা বা চারুকলার ভেতরের কেউ এর সঙ্গে জড়িত কিনা তা সবই খতিয়ে দেখা হবে।’
অনুমোদনহীন ক্যান্টিন চালায় শিক্ষার্থীরা
চারুকলার যে ক্যান্টিনের খাবার সরবারহ করা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে সেটির কোন অনুমোদন নেই। চারুকলার মূল ক্যান্টিনের অনুমোদন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরাদ্দ থাকলেও ভবনের অভাবে সেটি করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তাই শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে একটি জায়গা ঠিক করে একজন লোক দিয়ে এটি চালানোর ব্যবস্থা করেন। যেটি গত নয় মাস যাবত পরিচালনা করে আসছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কমপ্লেক্সের কর্মচারি জাকির। তবে এ ক্যান্টিনের কোন অফিসিয়াল অনুমোদন নেই।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যে ভবনটিতে আমাদের ক্যান্টিন হওয়ার কথা ছিল তার একটি দেয়াল ভেঙে পড়ায় আমরা আর তা করতে পারিনি। তাই শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে একজন লোক ঠিক করে ক্যান্টিন চালায়। যেহেতু আশেপাশে কোন খাবারের দোকান নেই, তাই শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমরাও নিষেধ করিনি। তবে অনুমোদন না থাকায় এর কার্যক্রমের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
ক্যান্টিন কীভাবে বরাদ্দ পেলেন জানতে চাইলে ক্যান্টিন পরিচালক জাকির চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ ও চারুকলার কয়েকজন বড়ভাইকে ধরে আমি ক্যান্টিনের বরাদ্দ পাই।’
‘বড়ভাইদের’ বিভিন্ন কর্মসূচিতে ফ্রি খাবার সরবারহের কথা বললেও এ ক্যান্টিন বরাদ্দ পাওয়ার জন্য কোন টাকা পয়সার লেনদেন করতে হয়নি বলে জানান জাকির।