গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘ যে পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে অন্তত চারটি বৈশিষ্ট থাকার পরেও স্বীকৃতি মেলেনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতম গণহত্যার। জাতীয় পর্যায়ে এ বছর থেকে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হলেই দিবসটির নেই কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
দেশের ইতিহাসবিদ এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকৃত ইতিহাস পাঠ বন্ধ এবং একটি ঘটনাকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই জরুরি।
১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া—এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই পাঁচটি বৈশিষ্টের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্য ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের রয়েছে। তাই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কোন কারণ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বাংলাদেশের মানুষ এত বড় গণহত্যার স্বীকার হলেও বিষয়টি বহির্বিশ্বে অতটা আলোচিত নয়, স্বীকৃতি না থাকার কারণে। পাকিস্তান এবং তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করে। তাই অনেকে ভুল ইতিহাস জানে। এই ভুল ইতিহাস পাঠ বন্ধ করার জন্য হলেও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জরুরি।
তিনি বলেন, গণহত্যা কোন দেশের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ নয়, এটি সারাবিশ্বের মানুষদের জন্যই অধ্যয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কোন বিকল্প নাই।
তবে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও কিছু গাফিলতি দেখছেন তিনি।
‘‘কোন বিষয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আগে প্রয়োজন জাতীয় স্বীকৃতি। কিন্তু জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতেই তো আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। অনেক পরে হলেও যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বা জাতীয়ভাবে পালন শুরু হয়েছে, ব্যাপারটি আশাব্যঞ্জক।’’
ইতিহাসবিদ এবং গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুনের মতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের আগে প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে বিষয়টি নিয়ে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে তার মীমাংসা করা।
চ্যানেল আই অনলাইনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্যি। কিন্তু সব সত্য কেউ স্বীকার করে কেউ করে না। স্বীকার না করলেও বিষয়টিতো আর মিথ্যা হয়ে যায় না।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রশ্ন তোলাকে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন এ বুদ্ধিজীবী।
‘‘কেন স্বীকৃতি পাচ্ছে না সে ব্যাপারে আপনি বিএনপিকে প্রশ্ন করেন। তাদের কাছে জানতে চান কোন তথ্যের ভিত্তিতে তারা একটা প্রতিষ্ঠিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করলো। এখন আপনি যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চান তবে তারাতো বলবে তোমাদের নিজেদের লোকই তো স্বীকার করে না, তাহলে আমরা কীভাবে স্বীকৃতি দেব। তখন আপনি কী জবাব দেবেন?’’
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাওয়ার আগে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট এ বিতর্ক আগে সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এ ব্যাপার সরকারকে আরও তৎপর হওয়ার ক্ষেত্রেও জোর দেন তিনি।