ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের মতো যে ঘটনা ঘটেছে তার শুরু মৌখিক পরীক্ষার নম্বরপত্রে এক শিক্ষকের ‘ভুলক্রমে’ ইনিশিয়াল (ছোট স্বাক্ষর) না দেয়াকে কেন্দ্র করে। ওই শিক্ষক সেটা জানার পর ইনিশিয়াল দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করতে চাইলেও ট্যাবুলেটর শিক্ষকরা সেটা না করে বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে নিয়ে যান, যে কারণে ফল প্রকাশে বিলম্ব ঘটে। শিক্ষার্থীদের ‘ক্লোজ গ্রুপে’ বিষয়টি পরিস্কার করতে গিয়ে অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাকে কেন্দ্র করেই পরে ৫৭ ধারায় ড. ফাহমিদকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন ড. আবুল মনসুর আহমদ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ফেসবুকে যে ক্লোজড গ্রুপে ড. ফাহমিদ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাতে ড. মনসুর ছিলেন না। ড. ফাহমিদের ব্যাখ্যার পর একজন এডমিনের সহায়তায় তিনি তাতে যুক্ত হন এবং এর ঘণ্টাখানেক পর গ্রুপটি ডিলিট হয়ে যায়।
ফেসবুকে ওই গ্রুপটি অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীনের পরামর্শে খোলা হয়েছিল। বিভাগের মাস্টার্স-২০১৬ (৬ষ্ঠ ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের কোর্স কো অর্ডিনেটর ছিলেন তিনি। ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য তিনি একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলতে পরামর্শ দেন, যেখানে তিনি ক্লাস রুটিন, পরীক্ষার তারিখ, রেজাল্টের ঘোষণা ইত্যাদি শেয়ার করতেন। মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের একটি কোর্সের শিক্ষকও তিনি। মিডিয়া রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস নামের কোর্সটিতে তার সহযোগী শিক্ষক ছিলেন ড. ফাহমিদুল হক। কোর্স শিক্ষক হওয়ায় তিনিও গ্রুপটিতে যুক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে কোর্স সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গ্রুপে আপলোড করতেন। এই দুই শিক্ষক ছাড়াও আরেকজন শিক্ষক মারজিয়া রহমানও ওই ক্লোজড গ্রুপটিতে যুক্ত ছিলেন। তাদের বাইরে অন্য কোন শিক্ষক গ্রুপটিতে যুক্ত ছিলেন না।
মাস্টার্স পরীক্ষার শেষে থিসিসের মৌখিক পরীক্ষা হয় চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি, যার ফল প্রকাশ হয় প্রায় সাড়ে চার মাস পর, ২০ জুন। সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৮ সপ্তাহের মধ্যে ফল প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা প্রকাশে এত বিলম্ব হওয়ায় এপ্রিল থেকেই শিক্ষার্থীরা ওই গ্রুপে পোস্ট করে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের কাছে ফল প্রকাশে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চান। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ফল প্রকাশে দেরি হচ্ছে। কিন্তু সেই জটিলতাটা কী সে ব্যাপারে তিনি পরিষ্কার কিছু বলেননি।
কোর্স কো অর্ডিনেটর হিসেবে মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক নাসরীন। সদস্য ছিলেন অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমদ, সহযোগী অধ্যাপক ড. এএসএম আসাদুজ্জামান এবং এক্সটারনাল পরীক্ষক ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক মনসুর শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি এবং ড. আসাদুজ্জামান ছিলেন ট্যাবুলেটরের দায়িত্বে।
২০ জুন তারিখ ফল প্রকাশ হলে অধ্যাপক নাসরীন ওই গ্রুপে পোস্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের জানান যে উপাচার্য মহোদয়ের বিশেষ সহযোগিতায় ঈদের আগেই ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে।
এরপর চলতি মাসের দুই তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশ হয় যে অধ্যাপক নাসরীন মৌখিক পরীক্ষায় ‘ঘষামাজা’ করার কারণে ফল প্রকাশে দেরি হয়। ওই সংবাদের লিঙ্কটি নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে শেয়ার করেন অধ্যাপক মনসুর। পরে অবশ্য সেখান থেকে তা ডিলিট করা হয়।
সংবাদের বিষয়টি জানাজানি হলে মাস্টার্সের ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের কৌতুহল সৃষ্টি হয় যে আসলেই তাদের ফলাফলে ‘ঘষামাজা’ হয়েছে কি না। কয়েকজন শিক্ষার্থী সংবাদের লিঙ্কটি মাস্টার্সের ওই গ্রুপে শেয়ারও করেন, কোর্স কো অর্ডিনেটর হিসেবে যে গ্রুপে আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক নাসরীন এবং সহযোগী কোর্স টিচার হিসেবে ড. ফাহমিদুল হক।
শিক্ষার্থীরা নিউজের বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করলে এক সময় অধ্যাপক ফাহমিদুল হক নিজেও মন্তব্য করেন। তিনি জানতে চান, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন এমন কাজ করতে পারেন এটা শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস হয় কি না! তিনি অভয় দিয়ে বলেন, ‘যারা এমনটি মনে কর তারা বলো কারণ তোমাদের তো মাস্টার্সের রেজাল্টও হয়ে গেছে।’
তার মন্তব্যের পরে একাধিক শিক্ষার্থী মন্তব্য করে ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়ার প্রকৃত কারণ জানতে চান তার কাছে। এরপর অধ্যাপক ফাহমিদুল হক পুরো বিষয়টি বর্ণনা করে একটি পোস্ট দেন ওই গ্রুপে। যে পোস্টের কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন অধ্যাপক ড. মনসুর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ড. ফাহমিদ শিক্ষার্থীদের জানান: গীতি আরা নাসরীন নম্বরপত্রে কিছু কাটাকুটি করেন। অর্থাৎ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একটি নম্বর দেওয়ার পর, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কেটে আরেকটি নম্বর দিয়েছেন। ভাইবা বোর্ডে এরকম হয়, একটি নম্বর দেওয়ার পরে নতুন আরেকটা নম্বর দেওয়া হয়। মূল্যায়নটা যখন সাবজেক্টিভ, তখন তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আসতে পারে। কাউকে ৩৫ দেবার পরই তার মনে হতে পারে, না, ও আসলে ৩৭ পাবার যোগ্য। সব শিক্ষকেরই এরকম হয়। আমরা এক্ষেত্রে কেটে নতুন নম্বর দিয়ে, পাশে একটা ইনিশিয়াল স্বাক্ষর দিয়ে দেই। এরকম কাটাকুটি গীতি আপা রোল নম্বরের ক্ষেত্রেও করেছেন। যেমন একজনের রোল নম্বর ইংরেজিতে লিখে হয়তো তার মনে হয়েছে বাকীগুলো বাংলায় লেখা। অতএব কেটে আবার বাংলা করা। এভাবে কিছু কাটাকুটি করেন তিনি, কিন্তু প্রয়োজনীয় ইনিশিয়াল স্বাক্ষর দেননি। এরকম কাটাকুটি লিখিত পরীক্ষার নম্বরপত্রেও হতে পারে, কিন্তু ইনিশিয়াল দিলেই সব ঠিক। উনার কাটাকুটি অনিচ্ছাকৃত এটা নিয়ে কোনই সন্দেহ নেই।
ট্যাবুলেটররা নম্বর নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন গীতি আরা নাসরীন তার জন্য নির্ধারিত নম্বরপত্রে কিছু কাটাকুটি করেছেন, কিন্তু ইনিশিয়াল দেননি। এক ট্যাবুলেটর ড. গীতিআরা নাসরীন এবং অন্য ট্যাবুলেটরকে ডেকে পাঠান। এরকম ভুলের ক্ষেত্রে ট্যাবুলেটরদের সামনে পরীক্ষক ইনিশিয়াল দেন। ড. গীতি আরা নাসরীনও তাই করতে চান। কিন্তু, তাকে তা করতে না দিয়ে বিষয়টি কন্ট্রোল অফিসে পাঠানো হয় যে কারণে বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায়।
বিষয়টি নিয়ে তদন্তও শুরু হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটার্নালকে সাক্ষ্য দেবার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির উত্তর পেতে পেতে কেটে যায় প্রায় তিন সপ্তাহ। এই সময়ের মধ্যে গীতিআরা নাসরীন কন্ট্রোল অফিসে যোগাযোগ করে রেজাল্ট দিতে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চান। এক পর্যায়ে বিষয়টি উপাচার্যর কাছে যায়। এক্সটার্নাল এসে সাক্ষ্য দিয়ে যান।
এ বিষয়টিই তার পোস্টে পরিস্কার করেন ড. ফাহমিদ। ৫৭ ধারায় মামলা করতে গিয়ে সেই পোস্টের যে স্ক্রিনশট ড. মনসুর পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় ড. ফাহমিদ লিখেছেন: ‘সামান্য এই বিষয় নিয়ে এরকম জটিল করে তোলার জন্য সেই টেবুলেটর ড. আবুল মনসুর আহামদের অবদান অসামান্য। ফলাফল প্রকাশে বিলম্বের কারণ যতটা না গীতি আপা, তার চাইতে বেশি এই বানিয়ে তোলা জটিল পরিস্থিতি। এই পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া এমনকি বিভাগের চেয়ারপারসনকেও ড. আবুল মনসুর সংশ্লিষ্ট রাখেননি। সবচেয়ে বড় কথা সহকর্মীসুলভ বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যার সহজ সমাধান করা যেত, তা অযথা জটিল করা হয়েছে। এই ধরনের শত্রুতামূলক উদ্যোগ বিভাগে আর কখনোই দেখা যায়নি। বর্তমান সিনেট সদস্য ড. মনসুর এই প্রক্রিয়াটি কন্ট্রোলার অফিস এবং প্রশাসনকে সঙ্গে রেখেই করেছেন।’
ড. গীতি আরা নাসরীনের সঙ্গে এরকম আচরণের কারণ হিসেবে ড. ফাহমিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রমোশন ও পদকেন্দ্রিক’ শিক্ষক রাজনীতির বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। তারা জানান, ড. ফাহমিদ এটাও উল্লেখ করেন যে ড. গীতি আরা নাসরিন রঙের রাজনীতির বাইরে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে সক্ষম বা আগ্রহী এবং এরকম স্বাধীন একজন মানুষের উপস্থিতি শিক্ষক রাজনীতিতে দল বদল করা মানুষের জন্য অস্বস্তিকর।
ড. ফাহমিদ তাদের একথাও বলেছিলেন যে, আর কেউ ড. গীতি আরা নাসরীনের মতো স্বাধীন চিন্তার মানুষের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায় নিয়ে কথা বলবেন না, তাই তিনিই বলছেন।