বিশ্বব্যপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় সব লেনদেনই করা হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের এই স্বীকৃতি আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে ডলারকে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেসময় থেকে প্রতিটি দেশ তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে মার্কিন ডলার সংরক্ষণ করতে শুরু করে।
ডি-ডলারাইজেশন
বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনে এককভাবে মার্কিন ডলার ব্যবহারের এই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিভিন্ন দেশ। তারা বৈদেশিক লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব মুদ্রা বা ভিন্ন কোন মুদ্রা ব্যবহার করার দাবি তোলে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন কোন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই ধারণাটিই হল ডি-ডলারাইজেশন।
‘ডি-ডলারাইজেশন’ কি একটি নতুন ধারণা?
‘ডি-ডলারাইজেশন’ শব্দটি নতুন হতে পারে তবে দেশগুলো কয়েক দশক ধরে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার মতো অনেক রাষ্ট্রপ্রধান বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন আধিপত্যের সমালোচনা করেছেন৷
চীন এবং রাশিয়াও সেই দেশগুলির মধ্যে রয়েছে যারা ডি-ডলারাইজেশনকে সমর্থন করেছে। এই বছরের জানুয়ারিতে তারা ঘোষণা করেছিল, ইরান এবং রাশিয়া যৌথভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি হিসাবে স্বর্ণভিত্তিক একটি নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু করবে।
এটি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ একটি রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির সর্বশেষ পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের অবস্থান এত শক্তিশালী কেন?
ডলারের প্রাধান্যকে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হলেও আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য সর্বাধিক স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত মুদ্রা হল মার্কিন ডলার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসার পর ১৯২০-এর দশকে মার্কিন ডলার পাউন্ড ও স্টার্লিংকে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে।
ব্রেটন উডস চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডলারের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, ১৯৪৪ সালের চুক্তিটি এমন একটি যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল যা মার্কিন ডলারকে বিশ্বব্যাপী বিশ্বের প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত করার অনুমতি দেয়।
একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হয়ে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি মুদ্রা যখন ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মুদ্রা’ হয়ে ওঠে, তখন তার পেছনে সবচেয়ে বড় মূল কারণটি হলো সেই দেশের ‘রপ্তানি’, ‘আমদানি’ নয়। কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যপী বার্ষিক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখায় মার্কিন ডলার ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মুদ্রা’ হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে।
তবে সারা বিশ্বে চীনের রপ্তানি দ্রুত বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক রপ্তানিতে শীর্ষে উঠে এসেছে চীন। চীনা ফ্যাক্টর ছাড়াও বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ অর্থনীতির কয়েকটি দেশ মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে চেষ্টা করছে।
ডি-ডলারাইজেশনের দিকে যাচ্ছে বিশ্ব?
মার্কিন ডলারের একাধিপত্যের বিপরীতে বিশ্বব্যাপী ‘ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইন’ গতি পাচ্ছে। চীনকে কেন্দ্র করে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ বা ডলারের আধিপত্য কমানোর একটি প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। চীন, ব্রাজিল ও ভারতের মতো বেশ কিছু উদীয়মান অর্থনীতি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের লেনদেনে ইতিমধ্যে ডলারের বিকল্প মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেছে। গত মার্চের শেষে বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তিতে পরস্পরের মুদ্রার ব্যবহারের জন্য চুক্তি করেছে চীন ও ব্রাজিল। গত ১৫ বছরে সম্পদশালী ব্রাজিলের প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা দখল করেছে চীন। আর্জেন্টিনা বলেছে, তারা মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে চীনা আমদানির অর্থ পরিশোধ করবে।
চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত, আসিয়ান দেশসমূহ, কেনিয়া এমনকি আরব রাষ্ট্রগুলোও এই প্রচারণার অংশ হয়ে উঠছে। তারাও ইউএস ডলারের বিকল্প খুঁজছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এক ফ্রান্সের কোম্পানির মাধ্যমে চীনে তাদের গ্যাস ইউয়ানে বিক্রি করছে। আসিয়ান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো তাদের বাণিজ্যকে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের মাধ্যমে ডি-ডলারাইজেশনের প্রচারণাকে ত্বরান্বিত করেছে। কেনিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রায় পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে তেল কিনছে।
কেন নতুন করে ‘ডি-ডলারাইজেশন’র আহ্বান জানানো হচ্ছে?
আমেরিকান ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের মতে, সুইফটের মতো আন্তর্জাতিক ডলার-বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ইরান এবং অতি সম্প্রতি রাশিয়ার (ইউক্রেন আক্রমণের জন্য) গভীর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে শুধুমাত্র মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতার জন্য। যা ছোট দেশগুলোকে বিকল্প খুঁজতে প্ররোচিত করেছে।
ভারত এবং মালয়েশিয়া সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা কিছু নির্দিষ্ট বাণিজ্যের লেনদেনের জন্য ভারতীয় রুপি ব্যবহার করা শুরু করেছে। একইভাবে সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী জানুয়ারিতে বলেছিলেন, তারা মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত।
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মার্কিন প্রভাববলয় থেকে বের হতে চাওয়া রাষ্ট্রগুলোকে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে সতর্ক করছে।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের নতুন মুদ্রা কি হতে পারে?
গত মার্চ মাসে ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়। উক্ত সম্মেলনে ডলারের বিকল্প হিসাবে একটি নতুন মুদ্রা চালু করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
আগামী আগস্টে আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত জোট) শীর্ষ সম্মেলনে নিজেদের মধ্যে লেনদেনের জন্য ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল রুবল, রুপি ও রেনমিনবি ইউয়ান আলোচনায় রয়েছে।
গত মাসে ভারতের নয়াদিল্লিতে সেন্ট পিটার্সবুর্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরামের অনুষ্ঠানে রাশিয়ার সংসদ ডুমার ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেকজান্ডার বাবাকভ এই বিষয়ে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ব্রিকস জোট আগামী সম্মেলনে এই বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। চলতি বছরের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় জোটটির আগামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বাবাকভ বলেন, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হলো একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করা, যার ভিত্তিতে সাধারণ মুদ্রার ব্যবহার সম্ভব। এখন এটি ডিজিটাল রুবল, রুপি না ইউয়ান হবে সেটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমাদের নিজ নিজ দেশের আইন অনুসরণ করবে এই মুদ্রা।
তিনি আরও বলেন, ভারত, রাশিয়া ও চীন এমন একটি বহুমুখী বিশ্ব তৈরি করছে, যা বেশিরভাগ রাষ্ট্র সমর্থন করে। নতুন আর্থিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এমন এক প্রক্রিয়া তৈরি হওয়া উচিত, যা ডলার ও ইউরোকে রক্ষা করবে না বরং নতুন মুদ্রা প্রচলন করে আমাদের লক্ষ্যপূরণে ভূমিকা রাখবে।