খবরে জানা যায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার রায় এবং দুদকের মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ২৪২ ব্যক্তি। চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর রয়েছেন।
চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুটি মামলা পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে আরও আছেন তাওয়াক্কুল কারমান, নাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা ও হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসসহ ১৬ জন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। এছাড়া জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, যুক্তরাজ্যের ধনকুবের স্যার রিচার্ড ব্রানসনসহ শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের তালিকায়। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সামরিক কমান্ডারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে আগুন সন্ত্রাসের বিষয়ে তারা নিরব, পুলিশ হত্যার ঘটনার ব্যাপারেও তাদেরপক্ষ থেকে কোন বিবৃতি আসেনা, হাসপাতালে হামলাকারীদের ব্যাপারে তাদের নিরব ভূমিকার কারণেই তাদের পক্ষ থেকে আসা সকল প্রকারের বিবৃতি মানুষের মনে বিশেষ ইঙ্গিতের বার্তা বহন করে।
খবরে আরও জানা যায়, চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট-এ বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রটেক্ট ইউনূস নামে একটি ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ড. ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১ জানুয়ারি আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এই চিঠি লেখা হয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূসের মামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘যার বিরুদ্ধে মামলা, তার সব দলিল-দস্তাবেজ তারা খতিয়ে দেখুক। সেখানে কোনো অন্যায় আছে কি না, তারা নিজেরাই দেখুক। তাদের এসে দেখা দরকার, কী কী অসামঞ্জস্য আছে।’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা সর্বশেষ চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা আপনার ওই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘এই পর্যালোচনার জন্য আমরা একজন জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক আইনজীবীর নেতৃত্বে স্বাধীন আইন বিশেষজ্ঞদের একটি দল পাঠানোর প্রস্তাব দিচ্ছি। আমরা দ্রুতই এটা শুরু করতে চাই। একই সঙ্গে পর্যালোচনা চলাকালে ড. ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায় স্থগিত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’ একটি দেশের প্রচলিত আইনকে কেবল একজন মানুষের জন্য পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে কিভাবে তারা বার্তাতে উল্লেখ করেন সেটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। এটি বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের নতুন কোন ইস্যু হতে পারে-এ ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার মত নয়।
২৪২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতি ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আকার প্রকাশিত হয়েছে। এই বিজ্ঞাপনের খরচ কে বহন করেছে; যারা বিবৃতি প্রদান করেছে তারা নিশ্চয়ই খরচ বহন করেননি।
তাছাড়া এই বিজ্ঞাপনের জন্য বিশাল অংকের অর্থ খরচ হয়েছে এটি সহজেই অনুমেয়। তবে ধারণা করা যেতে পারে বিশাল অংকের খবচ ড. ইউনূসকেই বহন করতে হয়েছে। হিলারি ফাউন্ডেশনে ড. ইউনূসের ডোনেশন প্রদানের খবরটি কারও অগোচরে থাকার কথা নয়। হিলারি ফাউন্ডেশন তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিশাল অংকের অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে ওয়েবসাইট থেকে ঘোষণা প্রত্যাহার করে।
আচ্ছা, করোনার সময়ে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে এ দেশের মানুষের জন্য কোনরূপ আর্থিক সাহায্য বরাদ্দের ব্যাপারে কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। অথচ করোনার মহামারীতে অনেকেই চাকুরিচ্যুত হয়ে বেকার হয়ে পড়েছিল, যারা দিন মজুর তাদের ঘরে অনটন অভাব মারাত্নকভাবে দেখা দিয়েছিল। সে সময়ে সামর্থবানরা যে যেভাবে পেয়েছে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে. অর্থ সাহায্য প্রদান করেছে; এমন পরিস্থিতিতেও ড. ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠান ছিল নির্বিকার।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্যের বিষয়ে সকলেই অবগত। বন্যা, খরা ও ঋতুভিত্তিক দূর্যোগে সরকার সাধারন মানুষের সুবিধা-অসুবিধায় বিবেচনায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। ঐ সকল ক্ষেত্রেও ড. ইউনূসের নিরুত্তাপ ভূমিকা আমাদেরকে ভাবনায় ফেলে, আমরা দেখেছি সংকটে দূর্যোগে বিবেকবান বিত্তশালীরা সামর্থ অনুযায়ী দুর্যোগে পীড়িতদের সহযোগিতা করে থাকেন। এটি মানবিক দায়িত্ব মনে করেই দায়িত্বশীলরা যার যার জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু ইউনূস ফাউন্ডেশনকে কখনো মানুষের কল্যাণে কাজ করতে দেখা যায়নি।
তাছাড়া ইউনূস ইস্যু নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলে বিদেশীদের ভূমিকা বিশেষভাবে আমাদেরকে ভাবায়। একজন মানুষের পক্ষে বিদেশীদের যত্রতত্র বিবৃতি, বিবৃতির যে একটা ওজন রয়েছে সেটিকে পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করে দিচ্ছে এ ধরনের বিবৃতি।
বাংলাদেশের কোন সংকটে তাকে পাওয়া যায়নি, অবশ্য একবার এ দেশের কতিপয় নামধারী মিডিয়ার কল্যাণে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে রাজনৈতিক দল গঠনের খায়েশ হয়েছিল তাঁর। এ নিয়ে বেশ বিবৃতি কলামও লিখেছিলেন নামধারী পত্রিকায়। সাংবাদিকদের মধ্যেও ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু এ দেশের জনগণের চোখের ভাষা মুখের ভাষা বুঝতে পেয়ে তিনি সে জায়গা থেকে ফিরে আসেন। এক অর্থে তার এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্যই ভাল হয়েছে, কেননা তার যে বিদেশপ্রীতি তিনি রাজনীতিতে আসলে বিদেশীদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতেই সময় কাটিয়ে দিতেন সেখানে দেশের জনগণ আলোচনার বাইরে থেকে যেতো। তাছাড়া বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীকে কোথাও পাওয়া যায়নি।
একটি মামলার বিচার যেখানে সকল নিয়ম অনুসরণ করে নিষ্পত্তি হয়েছে, সেখানে মামলার রায়ের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা, মামলাটিকে স্থগিত করে দেওয়া, মামলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার উপর কার্যাতই নগ্ন হস্তক্ষেপ। এ ধরনের বিষয়ে যারা বিবৃতি প্রদান করেন তাদের নিকট সবিনয় অনুরোধ থাকবে প্রকৃত বিষয়বস্তু জেনে বুঝে তারপরে পক্ষালম্বন করবেন। কেননা এটি একটি দেশের বিচারব্যবস্থাকে অপমান করার দৃষ্টতা ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়।
মামলার রায়ের পরে ড. ইউনূস জামিনে রয়েছেন এবং মামলার রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিলও করেছেন। কাজেই এ ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবার সুযোগ নেই। এছাড়া ইতিপূর্বে কর ফাঁকির মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ড. ইউনূস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে প্রায় ১২ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন। কাজেই ড. ইউনূস সম্বন্ধে এ ব্যাপারে একটি ধারণা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিবৃতিদাতাদের মধ্যে অনেকেই আইন প্রণেতা রয়েছেন। তারা কিভাবে একটি রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গের অনুরোধ করেন? বিবৃতি প্রদানের পূর্বে তাদেরকে ক্রস চেক, যাচাই বাছাই করাসহ অন্য দেশের আইনের শাসনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও সম্মানের বিষয়টি লক্ষ্য রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
কেবলমাত্র করোর অনুরোধ অথবা সামান্য টাকা প্রাপ্তির জন্য ব্যক্তির নিজস্বতাকে উপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। কেননা বাংলাদেশীরা মনে করেন, এ ধরনের বিবৃতি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত এবং প্রকারান্তরে হুমকির শামিল। আবার বাংলাদেশের যারা রাজনীতিবিদ, রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন কিংবা রাজনীতির খুঁটি নাটি নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন তাদের কাছে এ ধরনের বিবৃতি বাংলাদেশকে নতুন করে চাপে ফেলার ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। কিছুদিন হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, নির্বাচনকে ঘিরে দেশী বিদেশী ব্যাপক ষড়যন্ত্রের আভাস দেখা দিয়েছিল।
সকল কিছু উতরিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল সেটি ব্যর্থ হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারীরা ভিন্নদিকে মোড় নিয়েছে এবং তাদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে একটি বিচারকে ঘিরে তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)