ফার্সি শব্দ দরুদ। আরবিতে সালাত। সালাত শব্দের বহু অর্থ। আভিধানিক বিবেচনায় নামাজ, দোয়া, ইস্তেগফার, রহমত ইত্যাদির সবগুলোই সালাত অর্থে ব্যবহার হয়। তবে ইসলামের প্রচলিত পরিভাষায়, সালাত বলতে নামাজকেই বোঝায়। আর সালাত শব্দটি দ্বারা যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বুঝায় অর্থ্যাৎ ‘সালাত আলান নবী’ বললে এর অর্থ দাঁড়ায়, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ শরীফ। এই দরুদ শরীফই অত্র লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’য়ালা যত প্রকারের আমল করার জন্যে ঈমানদার বান্দাদের উদ্দেশ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তাতে দরুদ শরীফই একমাত্র আমল দেখা যায়, যার নির্দেশনার ক্ষেত্রে রাব্বুল আলামীন ভিন্নতা দেখিয়েছেন।
পৃথিবীতে এমন কোনো আমল নেই, যা প্রথমে আল্লাহ করেন, তারপর বান্দাকে করতে বলেন; তবে একমাত্র দরুদ শরীফ ছাড়া। একমাত্র দরুদ শরীফের ক্ষেত্রেই আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাবৃন্দ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে ইমানদারগণ, অতএব তোমরাও দরুদ প্রেরণ কর। সূরা আহযাব, আয়াত: ৫৬
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম দরুদ শরীফ। কোনো মজলিসে আলাপকালে যদি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উচ্চারিত হয়, তাহলে অন্তত একবার তাতে দরুদ শরীফ পাঠ করা ওয়াজিব। শরীয়ত এই বিধানটি আবশ্যক করেছে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: কৃপণ বলা হয় সেই ব্যক্তিকেই, যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হল; অথচ সে আমার প্রতি দরুদ পড়ল না। সুনানে তিরমিজি
দরুদ শরীফের রয়েছে বহুমুখী ফজিলত। দরুদ শরীফ পাঠের মাধ্যমে আমলনামায় অঢেল সাওয়াব অর্জন করা সম্ভব। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ১০টি রহমত নাজিল করবেন।
অন্য এক হাদিসে আছে: যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ১০টি রহমত নাজিল করবেন। তার ১০টি ভুল ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য ১০ স্তরের মর্যাদা উন্নীত করবেন। নাসাঈ
এমনকি দরুদ শরীফের মাধ্যমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য লাভের পথও সুগম হয়। যে উম্মত তার নবীর প্রতি যত বেশি দরুদ পাঠ করবে, নবীর সাথে তার সম্পর্ক ততটা নৈকট্যের হবে। যেমন, হাদিস শরীফে রয়েছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: কিয়ামতের দিন আমার সবচাইতে কাছের মানুষ তারাই হবে, যারা আমার প্রতি বেশি করে দরুদ পাঠ করবে। তিরমিজি, ইবনে হিব্বান, বাইহাকী
আমাদের দেশে দরুদ শরীফ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। ভুল ধারণাটা হল, দরুদ ইবরাহীম (নামাযে আমরা যে দরুদ পড়ি) ছাড়া আর কোনো দরুদ নেই। আর দরুদে ইবরাহীম ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দরুদের কথা হাদিসে নেই এবং সেই দরুদ পড়া যাবে না।
এই সূত্র ধরে কতিপয় নামধারী আলেমকে বলতে শোনা যায়, এদেশের জনমানুষের মুখেমুখে প্রচলিত ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা’ কিংবা ‘ইয়া নাবি সালামু আলাইকা’ এসব দরুদের কোনো ভিত্তি নেই!
সত্যি বলতে কি, তাদের এই দাবিরই কোনো ভিত্তি নেই। তার কারণ হাদিসে নেই এমন এক সংক্ষিপ্ত দরুদ আমাদের সবার মুখেমুখে। হাদিসের কিতাবের পাতায় পাতায়। সেই ছোট্ট দরুদটি হল, ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। এই দরুদ পাঠের ব্যাপারে হাদিসে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায় না। এটা হাদিসের বাইরের দরুদ হওয়া সত্ত্বেও আমরা সবাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাম মোবারক শ্রবণ করা মাত্রই এই দরুদ পড়ি। তাতে একথা একেবারেই স্পষ্ট যে, দরুদ শরীফ পাঠ করা বৈধ হবার জন্যে হাদিসের দরুদই হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
দরুদ ক্ষেত্রে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলেই দালায়েলুল খায়রাত, মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূলের মত বিশ্ববিখ্যাত দরুদ শরীফের কিতাব যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণ রচনা করেছেন। আমরা চাইলে এই রমযান মাসে বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে দরুদ শরীফের কিতাব থেকে প্রতিদিন কিছু অংশ পাঠ করার সিলেবাস গ্রহণ করতে পারি।