ভারতের মনিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি এবং সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষের কারণে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে এই রাজ্যে।
বিবিসি জানিয়েছে, ভারতের মনিপুরে মেইতি এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষের কারণে এই পর্যন্ত ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনা এই স্থানে নিয়মিত ঘটছে। নিহতদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কুকি। কুকি হলো- জোমি, চিন, হামার এবং মিজো আদিবাসীদের সম্মিলিত নাম যাদের বেশিরভাগই খ্রিস্টান।
গত মে মাসে উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন একে অপরের শত শত বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়াও তারা বিভিন্ন গীর্জা ও মন্দির পুড়িয়ে দেয়। উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০,০০০ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই এখনও স্কুল, ক্রীড়া কমপ্লেক্স এবং অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। অহরহ ঘটছে নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা।
ঘটনা-১
গত ৪ মে, দুইজন কুকি (জোমি) নারীকে নগ্ন করে ওই এলাকায় ঘুরাতে থাকে মেইতি পুরুষদের একটি দল। তাদের একজনের বাবা এবং ১৯ বছর বয়সী ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করার পাশাপাশি ওই নারীর মাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওই নারীর মা বলেন, আমার স্বামী গির্জায় কাজ করতেন। তিনি শান্ত ও দয়ালু ছিলেন। তার হাত ছুরি দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছিল। আমার ছেলে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল, এত ভদ্র ছেলে যে কখনো কারও সাথে মারামারি করেনি।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার ছেলেকে নির্মমভাবে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, কারণ সে তার বোনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। আমার মেয়ে সুস্থ হয়নি। তাদের তার সামনেই হত্যা করা হয়েছিল। তার খেতে ও ঘুমাতে সমস্যা হয়। আমার পরিবারের সাথে যা করা হয়েছে তার পর আমি কখনই শান্তিতে থাকতে পারি না।
এই ঘটনাটি মে মাসে একটি পুলিশ অভিযোগে নথিভুক্ত করা সত্ত্বেও তখন কোন তদন্ত করা হয়নি। জুলাই মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও প্রকাশ পেলে তদন্ত শুরু হয়। তখনই মনিপুরের সংঘাত ভারতে এবং সারাবিশ্বের অনেকের নজরে আসে।
ঘটনা-২
গত ২ জুলাই ডেভিড টুওলোর নামক একজন ৩৩ বছর বয়সী কুকি (হামার) ব্যক্তিকে মনিপুরের লাংজা গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মেইতিরা। তার মৃত্যুর পর অনলাইনে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তার ক্ষতবিক্ষত বিচ্ছিন্ন মাথা একটি বেড়ার ওপর আটকে থাকতে দেখা যায়।
ডেভিডের ছোট ভাই আব্রাহাম বলেন, এটা খুব বেদনাদায়ক ছিল। আমার ঘুমাতে সমস্যা হয়। এমনকি আমি আমার ফোনে তার ছবিও রাখি না। কারণ আমি যখন সেগুলো দেখি, কষ্ট বারবার ফিরে আসে এবং আমি সেই বিষয়গুলো ভাবতে শুরু করি। তিনি বলেন, ডেভিডকে নির্যাতন করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল এবং তার দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা কেবল তার কয়েকটি হাড় খুঁজে পেয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি এগুলো তারই।
ঘটনা-৩
৭ জুলাই ডেভিডের মৃত্যুর পাঁচ দিন পর, ২৯ বছর বয়সী এনগালিবা সাগোলসেম নামক একজন মেইতি পুরুষ, উত্তর মনিপুরের একটি কুকি-অধ্যুষিত এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। একদিন পর তার একটি ভিডিও সামনে আসে। এতে দেখা যায়, তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, তার হাত পিঠে বাঁধা, তার মুখ রক্তাক্ত এবং সে কাঁদছে। একদল লোক তাকে মারছে।
এর দুই মাস পর আরেকটি ভিডিও দেখা যায়, একই স্থানে তার মাথায় গুলি করে খাদে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
ঘটনা-৪
মনিপুরের ইম্ফল শহরের আরেক পরিবার তাদের মেয়ের খবর পেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। গত ৬ জুলাই ১৭ বছর বয়সী মেইতি মেয়ে লিন্থোইঙ্গাম্বি হিজাম তার বন্ধু হেমানজিৎ সিংয়ের সাথে কুকি-অধ্যুষিত এলাকার কাছে নিখোঁজ হন।
তাদের ফোন বন্ধ ছিল। তার বাবা কুলাজিৎ হিজাম দাবি করেছেন, কয়েক দিন পরে একটি কুকি মহিলার নামে নিবন্ধিত একটি সিম কার্ড দিয়ে ছেলেটির ফোন চালু করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমার মেয়ের কী হয়েছে তা জানতে কেউ আমাদের সাহায্য করছে না। আমি শক্তিহীন বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে সে ফিরে এসে আমাকে অবাক করে দেবে।