বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’ কিংবা ‘জীবনানন্দ পত্রাবলী’ যেমন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পত্রসাহিত্য বলে বিবেচিত, ঠিক তেমনি ইংরেজি সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ পত্রসাহিত্য বিবেচিত জার্মান কবি ও ঔপন্যাসিক রাইনের মারিয়া রিলকে তাঁর এক ভক্তকে লেখা দশটি চিঠি।
ভক্তের নাম ফ্রানজ কাপুস। কখনো দেখা হয়নি তাদের। শুধুই পত্রালাপ। ভক্তের সাথে কবির। যদিও রিলকের কাছে এ রকম চিঠি নতুন কিছু নয়। প্রায়ই আসত অপরিচিত, তরুণ ভক্তের চিঠি। প্রতিটি চিঠির উত্তর দিতেন ধৈর্য ও আন্তরিকতায়।
এসব চিঠিতে উঠে এসেছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, প্রেম, বিয়ে, ধর্ম, দর্শন—জীবনের সব গূঢ়বোধ রহস্য নিয়ে কবির মতাদর্শের। এক একটি চিঠি যেন কবিতার সমার্থক। লেখার সময়কাল ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল। এই দশটি চিঠি বিশ্বের অন্যতম সেরা পত্রসাহিত্য হিসেবে বিবেচিত। রিলকের মৃত্যুর তিন বছর পর কাপুস এই দশটি চিঠি প্রকাশ করেন।
সম্মানিত পাঠক, চিঠিগুলো পড়ে মনে হতে পারে কবি রিলকে যেন আপনার উদ্দেশেই লিখেছেন। যারা নতুন লিখছেন বা লিখতে চান, সৃষ্টিশীলতা যাদের জীবনের অংশ; বিশেষ করে তরুণ কবি-লেখকদের এই চিঠিগুলো কাজে আসতে পারে। অথবা যারা লেখালেখি করেন না কিন্তু ভালোবাসেন কিংবা শুধুই পড়তে ভালোবাসেন অথবা এর কোনটার সঙ্গেই নেই তবুও চিঠিগুলো আপনার কাজে লাগবে।
দশটি চিঠি ইংরেজি থেকে বাংলায় রুপান্তর করেছেন কবি ও সাংবাদিক জানাহারা পারভীন। সময় প্রকাশন থেকে ২০১০ সালে ‘রিলকে: নৈঃশব্দে ও নিঃসঙ্গতায়’নামে বইটি প্রকাশিত হয়। ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ১৩০ টাকা। প্রকাশের প্রায় ১৩ বছর পরে বইটির পাঠক আমি। জাহানারা পারভীন এর আগেও গবেষণা-অনুবাদে পারঙ্গমতা দেখিয়েছন ‘প্রফেট ও জিবরান’ও ‘এবং এলিয়ট’ গ্রন্থে। জাহানারা পারভীনের লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ আলোচিত কাব্যগ্রন্থ।
রিলকে সম্পর্কে জানতাম না। প্রিয় বড় আপা কবি জাহানারা পারভীনের পরামর্শে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রিলকে পাঠ শুরু করি। ১ মাসের বেশি রিলকে নিয়ে ডুবেছিলাম। প্রতিটি চিঠি পড়ে বিরতি নিয়েছি। ভেবেছি ও ভাবতে আমাকে বাধ্য করেছে। আমারও মনে হয়েছে, চিঠিগুলো যেন আমার উদ্দেশেই লেখা। বিশেষ যত্নে বইয়ের তাকে রেখে দিয়েছি বইটি। যখন মন খারাপ হয়, যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাই চিঠিগুলো পড়ি, কখনো একটা চিঠি বারবার পড়ি। যেভাবে নিত্যদিন ঘুম থেকে উঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনি।
ভক্ত কাপুসকে লেখা রিলকের প্রথম চিঠি থেকে চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো:
প্রিয় কাপুস,
এই মুহূর্তে তোমার একমাত্র কাজ হলো নিজের দিকে ফেরা। নিজের মুখোমুখি হও। খুঁজে বের কর— কেন তুমি লেখ। কে তোমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়? দেখ, সে তোমার মনের গভীরে শেকড় ছড়িয়ে বসেছে কি-না। ভেবে দেখো, লেখা ছাড়া তোমার পক্ষে বেঁচে থাকা আদৌ সম্ভব কি-না। রাতের সবচেয়ে নির্জন সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করো— আমাকে কি লিখতেই হবে? মনের গভীর থেকে খুঁজে আন প্রকৃত জবাব। উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে নিজেকে তৈরি করে নাও সেই জীবনের জন্য। প্রস্তুতি নাও ধীরে-ধীরে। যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে; এমনকি খুব সামান্য আটপৌরে সময়েও স্পষ্ট স্বাক্ষর হয়ে থাকুক এই অনুপ্রেরণা। এরপর এসো প্রকৃতির কাছে। যেভাবে এর আগে কেউ পারেনি, সেভাবে লেখো— যা দেখছ, শুনছ, যা অনুভব করছ। লেখ তোমার অন্তর্গত উপলব্ধির কথা, প্রেম ও বিরহের কথা।
যদি প্রতিদিনের জীবন খুব সাধারণ, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ মনে হয়, এজন্য জীবনকে দোষারোপ করো না। মনে করো, এ তোমার নিজের সীমাবদ্ধতা যে, এখনো কবি হয়ে উঠতে পারনি। কারণ জীবনের মহত্ত্ব ও বিশালত্বকে তুমি উপলব্ধি করতে পারছ না। সৃষ্টিকর্তার কাছে দরিদ্র এবং দরিদ্রতা বলে কিছু নেই, তার কাছে স্থান কাল পাত্র কিছুই তুচ্ছ নয়। জীবনে সব কিছুরই মূল্য আছে।
দুই.
‘রিলকে: নৈঃশব্দে ও নিঃসঙ্গতায়’বইয়ে দশটি চিঠি ছাড়াও ছয়টি প্রবন্ধে রিলকে-কে তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচ নাম্বার অধ্যায় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। এ অধ্যায়ে রিলকের লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘দুইনো এলিজি’লেখার আদ্যোপান্ত আলোকপাত করা হয়েছে।
দুইনো এলিজি: ‘দুইনো এলিজি’জার্মান কবি ও ঔপন্যাসিক রাইনের মারিয়া রিলকের লেখা বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ইংরেজি এলিজির বাংলা শোকগাঁথা। আর দুইনো একটি দুর্গের নাম। দুইনো এলিজি থেকে পাঠ করা যাক— ‘কে, যদি আমি চিৎকার করে উঠি/দেবদূত-অনুশাসনের মধ্যে আমার কথা শুনবেন?/এবং যদি ওদের মধ্যে কেউ হঠাৎ আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরেন/আমি তার জোরালো অস্তিত্বের চাপে মিলিয়ে যেতে পারি।’
এলিজিগুলো সম্পর্কে রিলকে নিজেই মন্তব্য করেছেন মহৎ কবিতা, অস্তিত্বের অংশ, দৈব থেকে পাওয়া। নাজিল হওয়া কবিতা, তিনি অনুলিখন করে গেছেন মাত্র। বলা হয়ে থাকে, বিশ শতকে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকের কাছে ইউরোপের আর কোন কাব্যগ্রন্থ এত সমাদৃত হয়নি দুইনো এলিজির মত। এলিজিগুলো রিলকের পরিণত কাব্যপ্রতিভার নিদর্শন, জীবন ও জগৎকে দেখার, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার উদাহরণ। এগুলো যেন কবিতা নয়, কবির অন্তর্গত বিশ্বাস, আত্মিক সংকটের মর্মকথা: বেদনার্ত রূপান্তরের সর্বোৎকৃষ্ট অনুসন্ধান, অনন্ত প্রেমের জন্য শোকার্ত অথচ ব্যর্থ কান্নার নামান্তর। প্রশ্ন ও বিলাপই এই কাব্যের মূল বিষয়। লেখার সময়ই বিলাপের ভাষা রপ্ত করেছেন রিলকে। রিলকের প্রশ্ন জেগেছে জীবন, মৃত্যু, সত্তা, শিল্পের রূপান্তর এবং কবিতা নিজেই কি প্রাথমিকভাবে শিল্পের পর্যায়ে পড়ে? উদগ্রীব হয়ে পৌনঃপুনিক স্বগতোক্তির মাধ্যমে এক একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়েছেন যে, আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান কোথায়? জীবন-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ কি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী? নশ্বর জীবনের সঙ্গে চিরন্তনের সেতুবন্ধন হওয়া সম্ভব কি-না তাও ভাবলেন। খুঁজতে চাইলেন পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সূত্র।
কীভাবে লেখা হলো দুইনো এলিজির কবিতাগুলো—সে গল্প জানা যাক। এলিজিগুলো লেখার অনুপ্রেরণার কথা রিলকে নিজেই জানিয়েছেন। রিলকে তখন বেড়াতে এসেছেন বন্ধু বাজকুমারী মেরি ভন থার্ন টাক্সিস হোয়েনলোহির প্রাসাদ দুইনো দুর্গে। ইতালির আন্দ্রিয়াতিক সমুদ্রের উপকূলে একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত দুইনো দুর্গের নিচেই উত্তাল সমুদ্র। রাজকুমারী কবিকে লেখার সুযোগ দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। কবির দেখাশোনার জন্য কয়েকজন কর্মচারি ছাড়া আর কেউ নেই। একদিন রিলকে সমুদ্র থেকে অনেক ওপরে দুর্গের পাথুরে টিলার ওপর পায়চারি করছেন। পুরো বাড়ি নির্জন। সমুদ্রের গর্জন ও ঝোড়ো আবহাওয়ায় বাতাসের শব্দ। এর মধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলেন এক কণ্ঠস্বর- যা প্রথম এলিজির প্রথম পক্তি হিসেবে পরিচিত। ‘কে, আমি চিৎকার করে উঠি যদি, হবে শ্রোতা ঐ/ দেবদূত পর্যায়ের মধ্য থেকে।’তৎক্ষণাৎ রিলকে দুর্গ থেকে কিছুটা বাইরে এলেন। ডানে-বাঁয়ে ভালো করে দেখলেন, দুইশ ফুট নিচে থাকা সমুদ্রের দিকে তাকালেন। কোথাও শব্দের উৎস খুঁজে পাওয়া গেল না। কবি নোটবুকে টুকে নিলেন আকস্মিক শোনা শব্দগুলো। ঘরে ফিরে অন্য একটি প্রয়োজনীয় চিঠি সেরে লিখতে বসলেন। সন্ধ্যার মধ্যেই লেখা হয়ে যায় দুইনো এলিজি গ্রন্থের প্রথম এলিজিটি। এলিজি থেকে আরেকটু পড়া যাক —‘সৌন্দর্য আর কিছু নয়/শুধু সেই আতঙ্কের আরম্ভ/যা অতি কষ্টে আমাদের পক্ষে নয় এখনো অসহনীয়/আরাধ্য সে আমাদের/যেহেতু সে শান্ত উপেক্ষার তার সাধ্য সংহার হবে না।’ কাব্যঘোর পেয়ে বসে তাঁকে। দশ-বারো দিনের ব্যবধানে লিখলেন দ্বিতীয় এলিজিটি। শুরু করলেন আরও কয়েকটি। কিন্তু আবারও থামতে হলো। এক বছর পর প্যারিসে শেষ করলেন তৃতীয়টি। ১৯১৫ সালে মিউনিখে লেখা হলো চতুর্থটি। এভাবে নানা সময়ে পুরো কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছেন রিলকে।
রাইনের মারিয়া রিলকে :
রিলকে ১৮৭৫ সালের ৪ ডিসেম্বর বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। রিলকের পুরো নাম রেনে কার্ল উইলহেম জোহান জোসেফ মারিয়া রিলকে। রিলকের ছোটবেলা খুব সুখের ছিল না। বাবা জোসেফ রিলকে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়ার পর রেলওয়ে অফিসার হন। মা সোফিয়ার সঙ্গেই রিলকের ছোটবেলার বেশিরভাগ সময়টা কেটেছে। রিলকের জন্মের আগেই তার মায়ের প্রথম কন্যাসন্তান মারা যায়। সেই শোক ভুলতে না পেরেই তার মা তাকে মেয়েদের পোশাক পরিয়ে রাখতেন। বাবা মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পরে তাকে জোর করে মিলিটারি একাডেমিতে পাঠানো হয়। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত সেখানে থাকার পর অসুস্থতার জন্য একাডেমি ছেড়ে দেন। ১৮৯৫ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। ১৮৯৬ পর্যন্ত তিনি সাহিত্য শিল্প ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে প্রাগ ও মিউনিখে পড়াশোনা করেন।
রিলকের লেখা কবিতা-গদ্য উভয়ই গীতিময়। একটা মিস্টিক বা রহস্যময় আঙ্গিক রিলকের লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বলা হয়ে থাকে, এলিয়টের মতোই তার বেশিরভাগ লেখাতে নিঃসঙ্গতা ও উদ্বিগ্নতা গ্রাস করেছে। সৃষ্টির মধ্যে অস্তিত্বের এই টানাপোড়েনই তাকে যথার্থ আধুনিক কবি করে তুলেছে। রিলকে তার ‘দুইনো এলিজি’কাব্যের জন্য বিখ্যাত হলেও জার্মান ও ফরাসি ভাষায় তিনি বহু কবিতা ও গদ্য লিখে গেছেন। Das Stunden-Buch বা ‘ঘণ্টার বই’(১৯০৫) হল তিনটি কবিতার সম্পূর্ণ সংকলন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ায় ভ্রমণকালে সেন্ট ফ্রান্সিস ও খ্রিশ্চান ধর্মের ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে কবিতাগুলি লেখা।
Die Aufzeichnungen des Malte Laurids বা ‘মাল্ট লরিডস ব্রিজের নোটবুক’(১৯১০) জার্মান ভাষায় লেখা রিলকের একমাত্র আত্মজৈবনিক ধাঁচের উপন্যাস। যৌবনে লেখা বইগুলোতে রিলকে বারবার নিঃসঙ্গতার প্রসঙ্গে ফিরে আসছেন।
মহান এ কবি ১৯২৬ সালে ২৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫১ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ড ভালমন্ট হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২৭ সালে ২ জানুয়ারি তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী রেরন গ্রামের গির্জার পাশে তের শতকের এক সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়। সমাধির ওপর রাখা হয় বিখ্যাত এপিটাফ।