জাতি হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, দীর্ঘ সংগ্রাম আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মুক্তির লাল সূর্য, লাল-সবুজ পতাকা আর বিশ্বমানচিত্রে গৌরবজনক এক স্থায়ী ঠিকানা। অধিকৃত পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রাম, আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতা আমাদের গৌরব আর সর্বসেরা অর্জন। পাশাপাশি বেদনারও। যুদ্ধ মানেই দগদগে ক্ষত। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা, কত মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া। কত আনন্দ-বেদনার রক্তকুসুমে গাঁথা বিজয়ের এই নির্মাল্যখানি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না, ছিল আদর্শের লড়াই। শত্রুর বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম অর্জনের বিজয়গাঁথা বাংলাদেশের ইতিহাস, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, শিল্পকলার মতো চলচ্চিত্রেও বিধৃত হয়েছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও তথ্যচিত্র এই চার ধারায় নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীচিত্রগুলো।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও না জানা অনেক গল্প বাংলা চলচ্চিত্রে এসেছে গৌরবময় ব্যঞ্জনায়। কিন্তু কোনো ক্যানভাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব হয়নি। তারপরও প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে দেখি। যদিও এই সময়ের নির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে নানাবিধ কারণে পিছিয়ে আছেন। জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে বিশাল এক ক্যানভাস দরকার। রয়েছে বাজেটের সমস্যাও। আবার বাণিজ্যিকভাবেও এসব ছবি থেকে খুব একটা অর্থ পাওয়া যায় না। তারপরও এই সময়ের তরুণ নির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই। তাদেরই একজন প্রবলভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতাড়িত এম.এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব মুক্তিযুদ্ধকেই অনুভব করতে চাইলেন। আর তাই ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি বিষয় নির্বাচিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ঘটনা ও স্মৃতিচারণাকে।
আমার অনেকগুলো ভ্রমণ-পর্যটন এবং জীবনীভিত্তিক তথ্যচিত্রের নির্মাতা-পরিচালক ও চিত্রগ্রাহক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধুবর বিপ্লবের কাজের মান ও ধারার সাথে পরিচিত আমি। সেই ভাবধারার পরিচয়কে ঝালিয়ে নিতে নানাবিধ সমস্যায় ‘গর্তজীবি’ হয়ে পড়ার পরও উপস্থিত থাকতে হয়েছিলো বিজয়ের মাসে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ফিল্ম আর্কাইভে শনিবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টায় প্রিমিয়ার শোতে, ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা, পরিচালক সুপ্রিয় স্বজন, বন্ধুবর এম এ জাহিদুর রহমান বিপ্লবের আন্তরিক আমন্ত্রণে। পলক না ফেলে সকলের সাথে প্রিমিয়ার শো দেখার সুযোগও হলো। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের অনুদানে ‘ওমর ফারুকের মা’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছিন্ন একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন স্বনামধন্য নাট্যজন মাসুম রেজা। গল্পটি পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার আশোয়া আমড়াঝুড়ি নামক স্থানের একজন মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক আর তার মায়ের।
১৯৭১ সালে যুদ্ধকালে ওমর ফারুক ২১ বছরের যুবক, ছিলেন পিরোজপুর সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। ওমর ফারুক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নির্ভিক যোদ্ধা। স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ২৩ মার্চ পিরোজপুরের টাউন ক্লাব চত্বরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ওমর ফারুক, পুড়িয়ে ফেলেন শহরের যত পাকিস্থানী পতাকা। এক সন্ধ্যায় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পিরোজপুরের ট্রেজারি ভেঙে লুট করেন অস্ত্র। আত্মগোপনে থেকে সুসংগঠিত করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধের সময় এক রাতে মাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন রাত্রে ফিরে মায়ের হাতে ভাত খাবেন। ওমর ফারুকের আর ফেরা হয়নি। সেই রাত্রেই তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার সময় তার কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের ৭টি পতাকা পায় পাক সেনারা। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে অকথ্য নির্যাতনে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তার; একটি পতাকা মাথায় হাতুড়ি পেটা করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, শহীদ হন ওমর ফারুক, ভাসিয়ে দেয়া হয় তার লাশ কীর্তনখোলা নদীতে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আজো পার হয়নি ওমর ফারুকের মায়ের, স্বজনদের অপেক্ষা। প্রবল আশাবাদী মা আজও ছেলের অপেক্ষায় তিনবেলা হাড়িতে ভাত বসান, রাতে সদর দরজা খোলা রাখেন ছেলের অপেক্ষায়, ছেলে আসবে সেই গভীর বিশ্বাসে! যে মা বাংলাদেশের হৃদয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন, নিরাশার বেদনা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায়, স্বপ্নের বিনির্মাণে।
চলচ্চিত্রটি দেখতে দেখতে ভাবতে থাকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে- বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়কে ঘিরে। যার মধ্য দিয়েই বাঙালি প্রথমবারের মতো নিজেদের একটি দেশ বা রাষ্ট্রের অধিকার লাভ করে। রাজা শশাঙ্কের ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যার বাঙালিত্ব নিয়েও দ্বিধার অবকাশ আছে, এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই বাঙালি প্রথমবারের মতো নিজেদের শাসনের ক্ষমতা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস কারও অজানা নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অভিজ্ঞতা থেকে লেখকরা গল্প, কবিতা এবং উপন্যাস লিখেছেন। শিল্পীরা গান গেয়েছেন। নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা ইতিহাসের ছায়া অবলম্বনে ঢালিউডে অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। যে ছবিগুলো তরুণ প্রজন্মকে কিছুটা হলেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন হতে শিখিয়েছে। খুব বেশি না হলেও যে সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মিত হয়েছে, সেগুলোয় যারা অভিনয় করেছেন তাদের রয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা কখনও সুখের, কখনও বা কষ্টের। সেই অভিজ্ঞতাকেই নান্দনিক শৈলিতে উপস্থাপনায় আন্তরিক সচেষ্ট ছিলেন বিপ্লবের সাথে অভিনয়শিল্পীগণ তথা ‘টিম বিপ্লব’।
বিশিষ্ট রুশ চলচ্চিত্রকার ও তাত্ত্বিক সের্গেই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রকে গ্রেনেডের মতো শক্তিশালী বলে মনে করতেন। আবার কারো মতে ক্যামেরা হচ্ছে রাইফেল। যে চলচ্চিত্রে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সত্তা- মূল্যবোধ অধিকার ইত্যাদির অংশগ্রহণ প্রতিফলিত হয় এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনে নির্মিত হয় সেসব চলচ্চিত্রকে মুক্তি সংগ্রামের চলচ্চিত্র বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে এ কথাটির প্রথম ব্যবহার লক্ষ করা যায় জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্মিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত এই প্রামাণ্যচিত্রের টাইটেলে তিনি ইংরেজিতে ব্যবহার করেছেন ‘ফিল্ম অন বাংলাদেশ ন্যাশনাল লিবারেশন ওয়্যার’, অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধারায় যে কোনো বিচারেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা। বাঙালির ইতিহাসের এমন তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় রুপালি পর্দায় রূপায়িত হবে, সেটা স্বাভাবিক তো বটেই, ভীষণভাবে কাম্যও বটে। এবং সেটা হয়েছেও। তবে পাঁচ দশকের পথ পরিক্রমা শেষে, সেই হওয়াটা পরিমাণগত ও গুণগত- দুই অর্থেই কাম্য পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা, এখন সময় এসে গেছে সেটা বিশ্লেষণ করারও। কারণ সেই বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করেই আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, রুপালি পর্দায় মুক্তিযুদ্ধের রূপায়ণের ভবিষ্যত গতি-প্রকৃতি কেমন হতে হবে।
‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও প্রদর্শনী স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে। যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের মহত্তম অধ্যায়। এর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্র। যুদ্ধ মানেই নারকীয় যন্ত্রণা। হোক সেটা একজন যোদ্ধা কিংবা সাধারণ মানুষের জন্য। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যুদ্ধ বয়ে নিয়ে আসে বৈরী বাতাস। গড়ে তোলে ধ্বংসযজ্ঞের পাহাড়। ছোট কিংবা বড় হোক, প্রত্যেকটি দেশেই কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতার ইতিহাস রয়েছে। হোক সেটা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ। দেশে দেশে এসব যুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সিনেমা। চলচ্চিত্র বলতে আমরা সহজভাবে বুঝি ‘সময় এবং জীবনের একটা জীবন্ত ক্যানভাস’। সত্য বলতে সময় এবং জীবনকে স্পর্শ করতে এই শিল্পের ভূমিকা অতুলনীয়। পার হয়ে যাওয়া বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনা আমরা বই পড়ে কিংবা বিজ্ঞজনের মুখ থেকে শুনে যতটা না আন্দোলিত হই বরং তার থেকে অনেক বেশি আন্দোলিত হই সময়টাকে চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখে। যার যথাযথ প্রভাবে আমাদের চোখ, মস্তিষ্ক এবং হৃদয় উদ্বেলিত হয়। ইতিহাস থেকে আমরা যা জানতে পারি বা উপলব্ধি করতে পারি বরং তার থেকে ঢের বেশি এর পটভূমিতে নির্মিত সিনেমা দেখে নারকীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করতে পারি। আর তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তার কোন বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা এবং গুরুত্ব ঠিক ঠিক বোঝাতে না পারলে সেটা সত্যিই আমাদের জন্য হবে অমঙ্গলের। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে এই দেশটির জন্যে আমরা একনদী রক্ত জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। আমাদের দেশে অনেক তরুণ নির্মাতা আছেন। তাদের হাতেই রয়েছে আগামী দিনের বাংলাদেশের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য। এই তরুণরাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের হাতেই আগামী দিনের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আমরা নিশ্চিত, তরুণরাই আমাদের স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। শত প্রতিকূলতা এড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘ওমর ফারুকের মা’ নির্মাণের মাধ্যমে সেই ধারাবাহিকতাকে তরুণ নির্মাতা ও পরিচালক এম এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব এগিয়ে রাখলেন। ‘ওমর ফারুকের মা’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো আমাদের শিক্ষাক্রমে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি বিবেচনা করি দেশপ্রেমের চেতনাবোধ জাগ্রত রাখতে। কারণ সঠিক ইতিহাস চেতনা না থাকলে মানুষের সাথে অন্য প্রাণির কোন মৌলিক তফাত থাকে না বলেই দার্শনিক নিটশেদের মতোন প্রজ্ঞাবানদের অভিমত।
‘ওমর ফারুকের মা’ কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, সময়ের শ্রেষ্ঠ দলিলও হয়ে ওঠে, কারণ সঠিক ইতিহাস চেতনা। পৃথিবীর বড় বড় সব যুদ্ধ, বিপ্লব ও মুক্তিসংগ্রাম অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র। তার অনেকটা সফল, কিছুটা সমালোচিত। সেই ধারাবাহিকতা কিংবা ছোঁয়া যা-ই বলি না কেন, সেটা আমাদের অর্থাৎ ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পেও লেগেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে পাক হানাদারবাহিনীর কাছ থেকে। এ নয় মাসের সংগ্রামের চিত্র কখনও যুদ্ধাকারে, কখনও গ্রামীণ পরিবেশে ওই সময়কার মানুষের জীবনযাপনের মাধ্যমে, আবার কখনও মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়া যোদ্ধাদের পথচলার গল্প সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেছেন অনেকে। মূলত যুদ্ধ শুরুর আগেই আমাদের চলচ্চিত্রে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেটা হয় ১৯৭০ সালে। এ সময় আমাদের প্রকৃত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আর সংগ্রামকে যে চলচ্চিত্রটি মূর্ত করে তোলে তার নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। মানুষকে যে চলচ্চিত্র আলোড়িত করতে পারে, তার প্রমাণ রাখলেন জহির রায়হান। তাঁর জীবন থেকে নেয়া মুক্তিসংগ্রামের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান প্রেরণা হয়ে আছে। একুশের প্রভাতফেরি সাউন্ড ট্র্যাকে ভেসে আসা সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র না পেলেও আমাদের হৃদয়ে অমোচনীয় কালিতে লেখা হয়ে আছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি দেশের যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি স্বাধীন মানচিত্রের জন্য কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষের প্রাণ। গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের বীভৎস এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ দশক। চলচ্চিত্রের কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার বিকাশ ও পরিণত হয়ে ওঠার জন্য সময়টা নিতান্ত কম নয়। এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও গণমানুষের জীবনে প্রভাবের বিবেচনায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধারায় এই সময়ে বিপুল পরিমাণ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। প্রয়োজন তো ছিলই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এত ঘটনাবহুল যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। এ কারণেই আমার প্রত্যাশা, উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও ভালো কিছু করে দেখাবে। এক্ষেত্রে জাহিদুর রহমান বিপ্লবের ‘ওমর ফারুকের মা’ আমাদের আশাবাদী করে তোলে।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ভাবতে বাধ্য করে সামগ্রিকভাবে তো নয়ই, কোনো বিচারেই এখনো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের ধারা আমাদের প্রত্যাশাকে ছুঁতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের আরও অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়া প্রয়োজন। সেগুলোতে উঠে আসার জন্য ইতিহাসের পাতায় গড়াগড়ি খাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অজস্র সিনেমাটিক সত্য কাহিনি। তবে আশাবাদটাও আবার ঠিক এই কারণেই। নির্মাণের ধারা যেহেতু পরিপুষ্ট হচ্ছে, গল্পেরও যখন অভাব নেই, সাথে রাজনৈতিক পরিবেশ ও দর্শকের অভিরুচি দুই-ই যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের পক্ষে অনুকূল, তখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের এই নবযাত্রা নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তার কোন বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা এবং গুরুত্ব ঠিক ঠিক বোঝাতে না পারলে সেটা সত্যিই আমাদের জন্য হবে অমঙ্গলের। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে এই দেশটির জন্যে আমরা একনদী রক্ত জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম।
‘ওমর ফারুকের মা’ দেখতে দেখতে মনে পড়লো পিরোজপুরের ভাগীরথী নামে এক নারীকে বর্বর পাকিস্তানীদের নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের কাহিনি। সেই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে কথাশিল্পী মনি হায়দারের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘কিংবদন্তীর ভাগীরথী’। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমা শহরে ভাগীরথী নামে এই নারীকে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী গাড়ির পিছনে বেঁধে রাস্তায় টেনে-হেঁচঁড়ে হত্যা করেছিলো, সেই ভাগীরথীকে নিয়েই তার এই উপন্যাস। উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে চরিত্রগুলোর সাথে জন্ম নেয় নানা প্রশ্ন, আত্মজিজ্ঞাসা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, যাঁরা লড়াই-এর ময়দানে প্রবলভাবে সক্রিয় ছিলেন, যে বীরাঙ্গনাগণ দুর্বিসহ জীবন যাপন করেছেন তাদের অন্যতম একজন পিরোজপুরের ভাগীরথী। তাদের অবদানকে স্মরণ করি কবি হুময়ূন কবিরের কবিতার চরণে- ‘তোমার মৃতদেহ আমি ধরতে পারিনি বুকে / ছুঁতে পারিনি আঙুল রেখে’। তবে ‘ওমর ফারুকের মা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সেই দৃঢ় শপথের উচ্চারণ তীব্রভাবে অনুভব করা যায়। ‘ওমর ফারুকের মা’য়ের বেদনা অশ্রু নদীতে ভেসে আসে ভাগীরথীদের স্মৃতির যূপকাষ্ঠ।
সন্তান হারানো ‘ওমর ফারুকের মা’য়ের দুঃখ কিংবা ভাগীরথীদের মতোন বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও রচনা সৃষ্টির অকৃত্রিম প্রীতি নিবেদনের, বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি দানের প্রচেষ্টার চেয়ে অনন্য উপহার আর কী-ইবা হতে পারে? সেই অনন্য অনুভবে প্রবলভাবে তাড়িত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘ওমর ফারুকের মা’ নির্মাণের জন্য এম এম জাহিদুর রহমান বিপ্লবকে অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে জানাই অভিনন্দন, অশেষ কৃতজ্ঞতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের সর্বত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলে তার এই প্রচেষ্টা সফল হবে বলে প্রত্যাশা করি।
লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা