সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর মাধ্যম হিসেবেই জানি। তবে গণমাধ্যম যে নয় এ কথাটি আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। নাগরিক সাংবাদিকতা মুখে বললেও এখনও সে পর্যায়ে আমরা পৌঁছুতে পারিনি। আরও সময় প্রয়োজন। এখানে মানে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজের একটা বড় সময় পার করতে হয়। যদিও বুর্জোয়া ফেসবুক অনেক দিক থেকেই বঞ্চিত করে রেখেছে আমাদের আঞ্চলিক যোগাযোগের জায়গাটি। কেন এমন অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য বাংলাদেশের ভাগ্যে তা পরে ভেবে দেখা যাবে অন্য কোনদিন। মূলত, কী কী কারণে আমরা এই যোগাযোগ মাধ্যমটি মানে ফেসবুক ব্যবহার করছি? কারো খবর নিতে, কাউকে খবর দিতে-এই তো? এর বেশি আর কী থাকতে পারে? সার-সংক্ষেপ কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
কয়েকবছর যাবত আমরা স্পষ্টতই লক্ষ্য করছি আমাদের দেশে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে, মানুষ শুধু মানুষকে আক্রমণই করেছে। অনেক বেশি দুঃসংবাদ আর আক্রমণে ভরে গেছে ফেসবুকের পাতার পর পাতা, নিউজ ফিড। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আর দশটা দেশে ফেসবুক ব্যবহার করে যারা উন্নয়ন এবং কল্যাণ সাধন করেছে, আমরা তা ব্যবহার করতে চাইছি এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে। গুটিকয়েক মানুষ এই ফেসবুক থেকে ভালো কিছু করার প্রত্যয় দেখাচ্ছেন এবং সফলও হচ্ছেন। কিন্তু অনেকের কাছে এখন ফেসবুক হলো এমন জায়গা যেখানে তিলকে তাল করা যাবে। যেখানে সত্য ঘটনাকে মিথ্যা দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে। যেখানে একদল অসুস্থ মানুষ একটি বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার লক্ষে তাদের হুকুমাত কায়েম রাখবে। যেকোন ইস্যুতে ফেসবুক-কে এক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমার মতে এখন ফেসবুক তিনটি হেডে অপারেশন হচ্ছে বাংলাদেশে: ১. মুসলিম ২. হিন্দু এবং ৩. দালাল। মুসলিম হেডের নীচে মানুষ চুন থেকে পান খসলে তাকে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাতারাতি অমুসলিম। বা চুন থেকে পান না খসলেও, তাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি। ধর্মীয় চেতনার চূড়ান্ত প্রতিফলন যেন ফেসবুক হয়ে গেছে। ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে কথা বললেই আপনি মুসলিম, নইলে আপনি কিছুই না- এমন ধারণাগুলো বেশ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এর প্রতিকার প্রয়োজন, বন্ধুরা। বিষয়টি এমন নয় যে একজন মানুষ তার ধর্মের কথা ফেসবুকে লিখতে পারবেন না বা কেউ লিখলেও তাকে কট্টর মুসলিম বলে তকমা দিতে হবে। বিষয়টা হলো, কে কী লিখলো তা নিয়ে কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই মুসলিম চেতনাধারী জনতা কারা আমরা তা জানি। আর কারাই বা ইসলামকে কটাক্ষ করতে চায়, তাদেরকেও চিনি। হিন্দু হেডটির নীচে বিভিন্ন মানুষকে আক্রমণ করা হচ্ছে যে তারা কীভাবে এই কাজ করলো, এই কাজটা তো হিন্দুদের মতো। অমুক কাজটা হিন্দুরা করে, আপনি কেন করলেন? আপনি পারলেন হিন্দুদের মতো ভাবতে? না ভাই, একজন মুসলিম হিসেবে হিন্দুদের পক্ষে এই কথা বলা আপনার ঠিক হয়নি। খেয়াল করুন, শুধু হিন্দু ধর্মের কথাটাই বেশি আসছে। অন্য ধর্ম নয়। আর, তৃতীয় হেডটি হলো দেশের কোন সংকট আর সম্ভাবনা, যা-ই বলিনা কেন এ নিয়ে কোন কথা যদি কোন কারণে সরকারের পক্ষে যায়-সেই হয়ে যাচ্ছে দালাল।
একজন মুসলিম হিসেবে আমি যেকোন ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করি। পবিত্র গ্রন্থ কুরআন এবং নবীর সহীহ হাদিসে এমন কথাই লেখা আছে। এবং, অবশ্যই আমি দালাল নই। এ কথাগুলো আমরা যারা নিজেদের মুসলিম হিসেবে দাবি করি, তাদের অবশ্যই মেনে চলা উচিত। আমিও সমালোচনা করি সরকারের। তবে তা যুক্তি-তর্ক দিয়ে। অযাচিতভাবে নয়। এমন নয়, যে করতে হবে বলেই করা। বা, ইচ্ছে হলো, করেই ফেলি। শেয়ার করি কোন সংবাদ যার কোন ভিত্তি নেই! তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশে কতোই না সমস্যা আছে, থাকবে- তার থেকে পরিত্রাণ পেতে সুস্থ সমালোচনা এবং কিছুটা নাগরিক-আত্মত্যাগ প্রয়োজন। হুট করেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না কোথাও। তাই বলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত এক বছর বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে যে নোংরামি চলছে, তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। যেকোন বিষয় আমরা এই তিনটি হেডের বাইরে ফেলে কী ভাবতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভেতর যে ভাল কিছু আছে, সেই দিকটির উপযোগিতা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি, কাজ করতে পারি। তবেই হয়তো এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না হয়ে আমাদের যে সামাজিক ব্যাধি হয়েছে, তার উপশম হবে।