তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে বিশ্ববাসী। বিশেষ করে মারাত্মক অবস্থা চলছে ইউরোপে। কখনও কখনও মনে হতে পারে পৃথিবী আগুনে জ্বলছে। ঠিক কতটা গরম হলে আপনার শরীরে খুব গরম অনুভূত হয়। চলুন দেখা যাক গবেষণা কী বলেছে।
বিবিসির প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গরমের কারণে সম্প্রতি ইটালিতে ‘সেটটিমানা ইনফারনেল’ বা নারকীয় সপ্তাহ হিসেবে এক সপ্তাহের নামকরণ করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রেকর্ড করা হয়েছে। এ সকল অঞ্চলে হাসপাতালে থাকা রোগীদের গরমের তীব্রতা থেকে রক্ষা করার জন্য বরফ ভর্তি ‘বডি ব্যাগ’ ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে গত জুন মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেবর্ড করা হয়েছে।
গত বছর ২০২২ সালে ইউরোপজুড়ে ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে এই তীব্র তাপপ্রবাহকে দায়ী করা হচ্ছে।
এদিকে জাতিসংঘ বলছে, বর্তমান ‘গ্লোবাল বয়লিং’ বা বিশ্ব গরমে সিদ্ধ হওয়ার যুগে অবস্থান করছে। আর এটিকে অবাক হওয়ার মতো কথা না উল্লেখ করে সমর্থন জানাচ্ছেন গবেষকরা।
আবহাওয়া অফিসের অধ্যাপক লিজি কেন্ডন বলেন, ‘আমি মনে করি, এখন এটি উপলব্ধি করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে বিষয়টা এমন নয়। এখনিই আমরা এমন কিছু উপলব্ধি করতে পাচ্ছি।’
তাপপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা হয় যেভাবে:
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের শরীরে এবং স্বাস্থ্যে কেমন অনুভূত হয় তা নিয়ে গবেষণা করেন সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যামিয়ান বেইলি। তার এই কাজে সহযোগিতা করেন ‘ঠাণ্ডার প্রভাব’ গবেষণায় অংশ নেওয়া এক ব্যক্তি।
ওই ব্যক্তি বলেন, ‘গরম অনুভূত হলে আমার শরীর ঘর্মাক্ত পানিতে পূর্ণতা পাই। আর এর ফলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু আমাকে তাপপ্রবাহ পরীক্ষায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অধ্যাপক ড্যামিয়ান বেইলি আমাকে একটি সাধারণ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চান। তাই আমি এতে অংশ নিয়েছি।’
তিনি বলেন, এই গবেষণা শুরু হয় ২১ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি বাড়ানো হয়, এবং সর্বশেষ ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠানো হয়, যা যুক্ত রাজ্যের উষ্ণতম দিনের সমান।
শুরুতেই অধ্যাপক বেইলি তাকে সতর্ক করে বলেন, ‘এখন আপনি ঘামতে থাকবেন এবং আপনার শরীরের বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা হবে।’
মূলত অধ্যাপক বেইলি তাকে একটি কক্ষে নিয়ে যান, যেটি তার গবেষণা কক্ষ হিসেবে ব্যবহার হয়। এটি এমন একটি কক্ষ, যেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম রয়েছে। যেগুলো এই বায়ুরোধী স্থানের ভিতরে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং অক্সিজেনের মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
তিনি বলেন, কক্ষে প্রবেশ করার পর বাহিরের দিকে তাকালে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একটি চুলার বাইরে তাকিয়ে আছি। তিনি বলেন, অধ্যাপক বেইলির প্রথম নির্দেশনার পর ‘কক্ষটি সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন এটি পুরোপুরি মনোরম ‘২১ ডিগ্রি’ তাপমাত্রায় ছিল।
আমি নিজেও একটি স্কিনে লক্ষ্য রাখছি আমার শরীরের পরিবর্তনের দিকে। লক্ষ্য করছি শরীর ঘামতে শুরু করছে এবং ধীরে ধীরে ওজন কমছে।
এর পরে আমাকে ত্বকের তাপমাত্রা এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ ট্র্যাক করে এমন একটি অ্যারের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানে একটি বড় যন্ত্র বায়ু ত্যাগ করার তা বিশ্লেষণ করে এবং একটি আল্ট্রাসাউন্ড আমার ঘাড়ের ক্যারোটিড ধমনী দিয়ে আমার মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ পরিদর্শন করে।
ধ্যাপক বেইলি আমাকে বলেন, ‘রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন সুন্দরভাবে কাজ করছে। এই মুহূর্তে সমস্ত শারীরবৃত্তীয় সংকেত আমাকে বলছে, আপনি স্পিফিং আকৃতি বা খুব ভালো আকৃতিতে আছেন।’
এরপর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করার জন্য একটি তালিকা মুখস্ত করতে দেওয়া হলো, যেখানে ৩০টি শব্দ রয়েছে। এরপর আবার তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করছে। আমার হৃদয়, ফুসফুস, লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গগুলির চারপাশে মূল তাপমাত্রা প্রায় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখা হয়েছে। অধ্যাপক বেইলি বলেন, ‘মস্তিষ্কের থার্মোস্ট্যাট বা হাইপোথ্যালামাস, ক্রমাগত তাপমাত্রার স্বাদ নিচ্ছে। আর মস্তিষ্ক ঠিক রাখার চেষ্টা করছে।’
তাপমাত্রা আরেকটু বাড়ানোর আগে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ একটি বিরতি নেওয়া হয়। ৩৫ ডিগ্রিতে অবস্থান করলেও কিছু্ক্ষণের মধ্যে গরম অনুভব হচ্ছিল, এটি অস্বস্তিকর বলা যায় না। তবে এমন গরমে আমাদের বিশ্রাম করতে ইচ্ছে করবে। কোন ধরণের কাজ করতে ইচ্ছে করবে না।
এরই মধ্যে আমার শরীরে কিছু পরিবর্তন স্পষ্ট হচ্ছে। আমার শরীর আরও লাল হয়ে যাচ্ছিল। এর কারণ আমার ত্বকের পৃষ্ঠের কাছাকাছি রক্তনালীগুলো আমার উষ্ণ রক্তের বাতাসে তাপ হারাতে সহজ করার জন্য খুলে যাচ্ছে। এছাড়াও আমি ঘামছি। এটি সাধারণ ঘাম নয়, ব্যাপক হারে হচ্ছে। ঘাম বাষ্পীভূত হয়ে আবার আমাকে শীতল করার চেষ্টা করছে।
ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে, এখন আমার শরীর ৪০.৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বহণ করছে। শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তাপ আমাকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। আমি দুর্বলতা অনুভব করছিলাম।
গবেষণা শেষে যা জানা গেল:
অধ্যাপক বেইলি বলেন, এটি রৈখিক নয়, এটি সূচকীয়। এর থেকে আর মাত্র ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি করা হলে আমি আর কিছু শুনতে পেতাম না। এছাড়াও এটি ছিল শরীরের জন্য বেশ চ্যালিঞ্জিং একটা বিষয়।
তিনি বলেন, আমি বেশ আনন্দিত হয়েছি এটা ভেবে যে, আমরা আর বেশি তাপমাত্রার দিকে যাচ্ছি না। আসলে এটা আমাকে বেশ দুর্বল করে দিচ্ছিল। আমার ভ্রু থেকে ঘাম মুছতে গিয়ে দেখি, আমাকে বেশ মলিন দেখা যাচ্ছে। আমার হাতগুলো কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছিল।
তিনি বলেন, যখন আমি আমার ঘর্মাক্ত কাপড় থেকে ঘাম বের করি এবং শরীরের ঘাম মুছে তা দাঁড়িপাল্লায় রাখি তখন এর ওজন ছিল এক লিটারের এক তৃতীয়াংশের বেশি পানি। অথ্যাৎ আমি পরীক্ষা চলাকালীন এই পরিমাণ ঘামছি। আর আমার শরীরের সেই ক্ষতগুলো স্পষ্ট হচ্ছিল। ত্বকের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আমার হৃদস্পন্দন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
শরীরের যে ক্ষতি করে:
হার্টের উপর এই অতিরিক্ত চাপের কারণেই তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং মৃত্যুর সম্ভবনাও তৈরি হয়। এছাড়াও রক্ত ত্বকের দিকে যাওয়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ কমে যায় এবং আমার স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তিও কমে যায়।
তিনি বলেন, ‘আমার শরীর ৩৭ ডিগ্রি তাপ পর্যন্ত গ্রহণ যোগ্যতা রাখে।’ এর অধিক তাপমাত্রা আমার জন্য অতিরিক্ত বলে মনে হয়।
আর্দ্রতা কতটা প্রভাবিত করে:
আমার পরীক্ষায় শুধুমাত্র তাপমাত্রা পরিবর্তন করা হয়েছিল। তবে তাপমাত্রা বিবেচনা করার জন্য অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বা আর্দ্রতা।
আপনি যদি কখনও গভীর রাতে সত্যিই অস্বস্তিকর হয়ে থাকেন তবে আপনি আর্দ্রতাকে দায়ী করতে পারেন। কারণ এটি আমাদের শরীরের শীতল হওয়ার ক্ষমতাকে হ্রাস করে। শুধুমাত্র ঘাম হওয়াই যথেষ্ট নয়। ঘাম বাতাসে বাষ্পীভূত হলেই এটি আমাদের শীতল প্রভাব দেয়। যখন বাতাসে উচ্চ স্তরের জল থাকে, তখন ঘাম বাষ্পীভূত করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।