২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা এর আগে হয়ত স্বপ্নেও ভাবেনি কোনো দেশ। অবিশ্বাস্য সেই কাজটাই করছে কাতার। নানা আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক শেষে আর কয়েকঘণ্টা পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসরের পর্দা উঠবে।
জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আল বাইত স্টেডিয়ামে পর্দা উঠবে এবারের আসরের। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক কাতারের মুখোমুখি হবে লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডর।
৬০ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার আল বাইত স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের পর্দা ওঠার দুই ঘণ্টা আগে, বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় হবে ৪৫ মিনিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
সাউথ কোরিয়ার বিখ্যাত ব্যান্ড দল বিটিএস’র সাত সদস্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন। অনুষ্ঠানে নিকি মিনাজ, জাংকুকসহ একাধিক তারকাকে পারফর্ম করতে দেখা যাবে। জে বালভিন, রবি উইলিয়ামস, জেসন ডেরুলো, ক্লিন ব্যান্ডিট, শন পল, ব্ল্যাক আইড পিস, মালুমা এবং মারিয়াম ফারেস মাতাবেন মঞ্চ। আরও থাকছেন বলিউড অভিনেত্রী নোরা ফাতেহি।
জানা গিয়েছিল অতিথি শিল্পী হিসেবে পারফর্ম করবেন শাকিরা। টুর্নামেন্ট শুরুর সপ্তাহখানেক আগে অবশ্য ব্যক্তিগত কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন জনপ্রিয় পপ তারকা। ব্রিটিশ পপ তারকা ডুয়া লিপার-এর নামও শোনা গিয়েছিল। তিনিও ইনস্টাগ্রামে জানিয়ে দিয়েছেন কাতারে গাইবেন না। গায়ক রড স্টুয়ার্ট জানিয়েছেন, কাতারে পারফর্ম করার জন্য এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি পারিশ্রমিকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এবারের বিশ্বকাপের থিম সং ‘হায়্যা হায়্যা’ বা ‘বেটার টুগেদার’। কণ্ঠ দিয়েছেন স্বাগতিক দেশের গায়িকা আয়েশা ও আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী ত্রিনিদাদ কার্ডোনা।
গত এক সপ্তাহে কাতারে পৌঁছেছে বিশ লাখেরও বেশি দর্শক-সমর্থক। ৩২ দেশের সমর্থকরা প্রিয় দলের খেলা মাঠে বসে বা মাঠের বাইরে বড় পর্দায় উপভোগ করতে পারবেন।
এবারের আসরে আটটি গ্রুপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৩২টি দেশ। আয়োজক কাতার বাদে বাকি ৩১টি দেশকে বাছাইপর্বের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে হয়েছে।
আট স্টেডিয়ামে হতে চলা ৬৪টি ম্যাচের জন্য প্রায় ৩ মিলিয়ন টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। বিদেশী সমর্থকরা এবার কাতারে প্রবেশের জন্য হায়া কার্ড পেয়েছেন। এই কার্ডের মাধ্যমে গণপরিবহনে বিনা টিকিটে ভ্রমণ ও স্টেডিয়ামে ম্যাচ টিকিটের পাশাপাশি প্রবেশের জন্য অনুমতি হিসেবে গণ্য হবে।
কাতার আয়তনে ছোট দেশ হওয়ায় বিশ্বকাপের আট ভেন্যু কাছাকাছি হওয়ায় দর্শকরা চাইলে গ্রুপ পর্বের প্রতিটি ম্যাচ মাঠে গিয়ে উপভোগ করতে পারবেন।
এবারের আসরে নেইমারের ব্রাজিল ও লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে হটফেভারিট হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন সারাবিশ্বেরই ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। সেইসঙ্গে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল, সার্জিও বুসকেটসের স্পেন ও কাইলিয়ান এমবাপের বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ফেভারিটের তালিকায় রাখা হচ্ছে।
ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বকাপ জুন-জুলাই মাসে হয়ে থাকে। সেই সময়টাতে কাতারে থাকে মারাত্মক গরম। তাই বাস্তবতা মেনে ফিফার প্রচলিত প্রথা ভেঙে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়।
ঘুষ দেয়ার বিনিময়ে বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়া, স্টেডিয়াম নির্মাণে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সমকামীদের কাতারে প্রবেশে বাধা দেয়া— এসব কারণে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয় কাতার। এসবের মাঝে দেশটি নান্দন্দিক স্টেডিয়াম, উচ্চাভিলাষী ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে। রক্ষণশীল দেশ হয়েও অ্যালকোহল পানের সুবিধা দিয়েছে কাতার। যদিও স্টেডিয়ামের ভেতর অ্যালকোহল পানে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে চলছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
প্রথাসিদ্ধ ২৩ সদস্যের পরিবর্তে দলগুলো স্কোয়াডে সদস্য বাড়িয়ে ২৬ জন নিয়ে কাতারে গিয়েছে। আসছে বিশ্বকাপে ম্যাচে তিন পরিবর্তনের বদলে পাঁচ ফুটবলার বদলের সুযোগও পাবেন কোচরা।
অফসাইড নিয়ে বিতর্ক নিরসনে কাতার বিশ্বকাপে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ফিফা। অফসাইড শনাক্তকরণে থাকছে সেমি-অটোমেটেড প্রযুক্তি। স্টেডিয়ামে ছাদের নিচে মোট ১২টি ক্যামেরা বসানো হবে এই প্রযুক্তির জন্য। এর মাধ্যমে মাঠে বলের গতিবিধি দেখা হবে। বলের সঙ্গে খেলোয়াড়ের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে খেলোয়াড়দের শরীরের ২৯টি জায়গার অবস্থানও দেখা যাবে ক্যামেরার মাধ্যমে।
সেকেন্ডে প্রতিটি খেলোয়াড়ের শরীরের অবস্থানের ৫০টি করে তথ্য মিলবে এই প্রযুক্তিতে। এতে বল ও খেলোয়াড়ের সঠিক অবস্থান বোঝা যাবে। এছাড়া বলের ভেতরেও সেন্সর বসানো হবে। অফসাইডের ব্যবধান খুব অল্প কিংবা একেবারে সূক্ষ্মতম হলেও সেটি ধরা পড়বে এই সেন্সরে।
ফুটবল ইতিহাসে ছেলেদের মেগা টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পাননি কোনা নারী রেফারি। কাতার বিশ্বকাপে ভাঙছে সেই নিয়ম। আসছে বিশ্বআসরের অফিসিয়াল রেফারির তালিকায় আছেন ৬ জন নারী।
৮০ হাজার ধারণ ক্ষমতার লুসেইল স্টেডিয়ামে ১৮ ডিসেম্বর ফাইনাল মহারণ হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়। সেই লড়াইয়ে শেষ হাসিটা যারা হাসবে, তারা চার বছরের জন্য পেয়ে যাবে বিশ্বকাপ ট্রফি। পুরনো কারো মাথায় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট উঠবে নাকি নতুন কেউ হবে চ্যাম্পিয়ন, তা আপাতত সময়ের হাতেই তোলা থাকছে।