প্রতিদিনের মত সময়মত স্কুলে এসেছে তারা। তবে কাঁধে নেই বইয়ের বোঝা। চোখে-মুখে নেই সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার বিরক্তি। উৎসবের আমেজ তাদের অভিব্যক্তিতে, চোখে খুশির ঝিলিক, অনুপম এক আভা।
কারণ তারা ক্লাস করতে নয়, এসেছিল প্রতিনিধি নির্বাচন করতে! নিজে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে তাদের নেতাদেরকে। যাদের নেতৃত্বে তারা অংশগ্রহন করবে স্কুল উন্নয়নের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে।
বৃহস্পতিবার সারাদেশের প্রায় ২২ হাজার মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-মাদ্রাসায় উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্টুডেন্টস ক্যাবিনেট নির্বাচন-২০১৭’। নির্বাচনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে গঠন করেছে তাদের কাঙ্ক্ষিত মন্ত্রিসভা, যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন ‘প্রধানমন্ত্রী’।
শুধু কি ভোট! নির্বাচনী এই মহাযজ্ঞের সমস্ত দায়িত্বই তো এই সব ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হাতে। তাদের মধ্য থেকেই একজন হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যার অধীনে আরও দুজন কমিশনার।প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং এজেন্টসহ সুষ্ঠভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্বও পালন করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা কেবল এসব কাজে তাদের সহযোগিতা দিয়ে গেছেন।
নির্বাচনের এ পরিসর ছোট হলেও ক্ষুদে এই শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি সুদুরে। তাদের প্রত্যাশা এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসহ গড়ে উঠবে পরমসহিষ্ণুতা। একে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখবে। সার্বিকভাবে একজন যোগ্যতর নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন তাদের চোখে।
তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এবারের ‘স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট নির্বাচনে’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছে বিদ্যালয়টির ১০ম শ্রেণির ছাত্রী নাঈমা আক্তার রক্সি। চ্যানেল আই অনলাইনকে সে বললো, স্কুল পর্যায়েই আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি জাতীয় নির্বাচন যেভাবে হয় সে সম্পর্কে জানতে পারছি। তাছাড়া এই নির্বাচনে ৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষার্থী অংশগ্রহন করছে। প্রার্থীদের মধ্য থেকে যারা নির্বাচিত হবে এবং যারা হবে না তাদের সবাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করবে। এতে আমাদের মধ্যে এক ধরনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে।’
ভবিষ্যতে এ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মাঝে অনেক বড় প্রভাব ফেলবে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে রক্সি আরও বলে: ভবিষ্যতে হয়তো এদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে অনেক বড় বড় জাতীয় নেতৃত্ব। আমাদের মধ্য থেকেই কেউ হবে নির্বাচন কমিশনার, জাতীয় সংসদেও হয়তো যাবে কেউ।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ১০ শ্রেণির ছাত্রী ফাহমিদা সুলতানা। এই নির্বাচনের শিক্ষণীয় দিকগুলো তুলে ধরে চ্যানেল আই অনলাইনকে সে বলেছে, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়বে। যারা আমাদের নির্বাচিত করবে আমরা তাদের সকলের মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব। এর ফলে আমাদের মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগিতাও বাড়বে।’
স্কুলের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিজেদের করণীয়ও তারা তুলে ধরলো প্রাজ্ঞ নেতার মত। দিলো নানা প্রতিশ্রুতিও।
স্কুলের শিক্ষার পরিবেশে উন্নয়ন এবং সার্বিকভাবে নিজেদের যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তোলার কাজে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কররছে ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রত্যাশাও।
ক্ষুদে এই শিক্ষার্থী অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় চ্যানেল আই অনলাইনকে জানালো নির্বাচনে আসার কারণ এবং অনুপ্রেরণাগুলো।
‘বাংলাদেশের স্কুলগুলো হবে বিশ্বমানের’ এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সে বলে, ‘সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই।’
যেমন ছিল ভোটের পরিবেশ
সকালে রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বিদ্যালয়ের পূর্বদিকের ভবনের তিনটি ফ্লোরে চলছে ভোটগ্রহণ। নির্বাচন কমিশনারসহ, প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে সাবলীলভাবে। এই স্কুল থেকে দুই শিফটের প্রতিটিতে ৮ করে মোট ১৬ জন প্রনিনিধি নির্বাচিত হবে। পদগুলোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে মোট ৩৬ জন ছাত্রী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আলাদাভাবে বসানো হয়েছে নির্বাচন কমিশন কক্ষে।
স্কুলের নির্বাচনের সার্বিক বিষয় তুলে ধরে স্কুলটির শিক্ষিকা নাসরিন সুলতানা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ যত সুনিপুণভাবে করছে তা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। আশা করি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে তাদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ভবিষ্যতে তাদেরকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে।
শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতি যোগ করে ভিন্নমাত্রা
নির্বাচন পরিদর্শন করতে সকাল ১১টার দিকে তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ঘুরে দেখেন এবং সবকিছু সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
পরিদর্শন শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে উদাহরণ সৃষ্টি করছে তা পুরো জাতিকে উৎসাহিত করবে এবং পথ দেখাবে।
স্কুল পর্যায়ে নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্য তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা চাই এ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জেগে উঠুক।
‘অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতকে মেনে নেওয়া… আমি জিতলেও যাতে অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নগণ্য মনে না করি, হারলেও যেন অন্যের প্রতি বিদ্বেষী না হয়ে সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করি। এভাবেই সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার মনোভাব যাতে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে আমাদের মূল উদ্দেশ্য সেটাই।’
নির্বাচনের উদ্দেশ্য ও ক্যাবিনেটের কর্মপরিধি
সাতটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০১৫ সাল থেকে এ নির্বাচন আয়োজন করে আসছে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে: শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মুল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন, শিক্ষকদের সহযোগিতা করা, শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে সহযোগিতা করা, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশহণ নিশ্চিত করা প্রভৃতি।
নির্বাচিত ‘স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট’-এর কর্মপরিধি মোট সাতটি। এগুলো হচ্ছে: নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সংরক্ষণ, পুস্তুক ও লিখন সামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, পানি সম্পদ, বৃক্ষরোপণ, দিবস পালন ও আইসিটি।
ক্যাবিনেটের সাতজন ‘মন্ত্রী’কে একটি করে দায়িত্ব দেওয়া হবে। সার্বিকভাবে সমন্বয় করবেন ‘প্রধানমন্ত্রী’।
প্রতিষ্ঠান, ভোটার ও প্রার্থী
তৃতীয়বারের মত আয়োজিত এ নির্বাচনে এবার দেশের ৪শ ৮৭টি উপজেলা ও ৯টি মহানগরের ২২ হাজার ৯০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোট হয়। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫০৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৬ হাজার ৪০২টি মাদ্রাসা।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভিত্তিক ৮ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে। সর্বোচ্চ ভোট যে পেয়েছে সে ‘প্রধানমন্ত্রী’ এবং অন্য প্রতিনিধিরা ‘মন্ত্রী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন এবং প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব শিক্ষার্থীরাই পালন করেছে।
মোট ১ লাখ ৮৩ হাজার ২৭২টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে ২ লাখ ৭১ হাজার ২৯৯ জন শিক্ষার্থী। মোট ভোটার ছিলো ১ কোটি ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫১ জন। তারা ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
ছবি: সাকিব উল ইসলাম