দেশের অভিনয় জগতের গুণী শিল্পী মাহফুজ আহমেদ। আজ জনপ্রিয় এই অভিনেতার জন্মদিন। অভিনেতাকে সামাজিক মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জনপ্রিয় নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী।
আমার অনেক গর্ব হয়, অনেক মন ভালো লাগা কাজ করে, আনন্দে চোখ ভিজে আসে যখন দেখি আমার মত সাধারণ একজন নির্মাতার সিনেমায় অভিনয় করার জন্যে তিনি অনেক ভালো ভালো অফার, স্ক্রিপ্ট, ফিরিয়ে দিয়ে আড়াই বছর ধরে আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র প্রহেলিকার সাথে ছিলেন, নিজেকে তৈরি করেছিলেন এবং প্রমাণিত করেছেন এই ঈদেই তার দর্শকের কাছে, ‘ওল্ড ইজ অলওয়েজ গোল্ড।’
বলেছিলেন, “প্রহেলিকা দিয়ে কাম ব্যাক করতে চাই, প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর আগে অন্য আর কিছু নয়।” আসলেই তাই। ভালো কাজের প্রেমে পড়েন তিনি, ভালো স্ক্রিপ্ট, ভালো ভিন্ন গল্পের প্রেমে পড়েন তিনি। সাথে লাগে একটি সুন্দর মনের মত টীম আর পরিবেশ। যেখানে তার কাছে টাকাটা খুবই গৌণ।
প্রহেলিকা রিলিজের আগে তিনি তার প্রায় প্রতিটি ইন্টারভিউতে, প্রমোশনের সময়,বড় বড় পত্রিকায় বলেছেন, “আমার ৩৫ বছরের ক্যারিয়ার এ পরিচালক চয়নিকা চৌধুরীর কাছ থেকে আমি সেরা উপহার পেয়েছি।” আমি সেইদিন স্তম্ভিত হয়েছিলাম, হয়েছিলাম বিস্মিত। এইভাবে প্রকাশ্যে এত সম্মান আমি পেয়েছি একজন অভিনয় শিল্পীর কাছে বার বার!
বাংলাদেশে রিলিজের সময় উপচে পড়া ভিড়, টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না, মুষলধারে বৃষ্টিতেও হলে জায়গা ছিলনা এমন মুহূর্তের দর্শকরাই বলে দেয়, সত্যিই তার ফিরে আসাটা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ছিল। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল। আমি অনড় ছিলাম। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেছিল, “চয়নিকা চৌধুরী তুমি ভুল করোনি, ঠিক সিদ্ধান্তেই আছো।” কারণ, আমাদের অনেক কাজের জুটি, অনেক রোমান্টিক আর সম্পর্কের কাজ আমরা একসাথে করেছি। সে আমাকে চেনে, বোঝে। আমিও তাকে শতভাগ চিনি আর বুঝি।
বাংলাদেশের সুপারহিট এর পর অস্ট্রেলিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় রঙ্গন মিউজিক প্রযোজিত পান্থ শাহারিয়ারের এর প্রহেলিকা সিনেমা। তারপর বায়স্কোপ ফিল্মস-এর আমন্ত্রণে আমেরিকার পাঁচটা ষ্টেটে নিজেই গিয়ে দেখেছি, তিনি কী পরিমাণ জনপ্রিয়! সত্যিই তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন ৩৫ বছরের তার অভিনয়ের ক্যারিয়ার জীবনের পরিশ্রম, মেধা, যত্ন, তার মানুষের সাথে মুগ্ধ করা ব্যবহার, তার সহকর্মী আর টীম মেম্বারদের সম্মান দিয়ে কথা বলা কিছুই বৃথা যায়নি। মাহফুজ আহমেদ একজনই হয়।
“তোমাকে যে ছোট করে, সেই আসলে ছোট.. বউদি, তুমি মানুষকে সম্মান দিতে জানো। তুমিই বড়! তোমার কাজ কথা বলবে, মন দিয়ে কাজ করে যাও।”
আমার জন্মদিনে আর টিভির লাইভে কথাগুলো বলেছিলেন প্রিয় অভিনেতা, প্রিয় নির্মাতা, প্রিয় মানুষ, প্রিয় পরিবারের বন্ধু মাহফুজ আহমেদ। সেদিন চোখ ঝাপসা হয়েছিল। আসলে সত্যিই সহজ কথা যায়না বলা সহজে।
তার কাছ থেকে এখনো প্রতি মুহূর্তে শিখি, জানার চেষ্টা করি। যখন অনেক ফ্রাসটেটেড হয়ে যাই তখন এই প্রিয় মানুষের সব কথা আমাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে।
মাহফুজ আহমেদকে চিনি ১৯৮৯ থেকে.. ইমদাদুল হক মিলনের লেখা, ফখরুল আবেদীন দুলালের ফখরুল আবেদিনের “কোন কাননের ফুল” নাটক থেকে। তাকে প্রথম দেখি রির্হাসেলে। আমার বোন তমালিকা ঐ নাটকের আর্টিস্ট ছিল। আরো ছিল শমী কায়সার, মুনিরা ইউসুফ মেমী। আজিজুল হাকিমের বন্ধুর চরিত্রে, শখের ছোট অভিনয়। কী দারুণ স্পষ্ট উচ্চারণ!
তাকে আমি প্রথম জার্নালিস্ট হিসেবে চিনতাম। তারপর ১৯৯০ সালে অরুণ চৌধুরীর সাথে বিয়ের পর দেখেছি বহুবার। আমাদের বাসায় লম্বা আড্ডায় কখন যে সময় চলে যেতো! আমার ছেলে অনন্য প্রতীক চৌধুরীর মুখে প্রথম অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে তিনি ভাতও খাইয়ে দিয়েছিলেন।
“কোথাও কেউ নেই” নাটকের দারুণ অভিনয়ের সূত্র ধরেও অনেক বার দেখা হতো। এরপর আমাদের ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে গেলেন। বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, শিরি হায়াতের বাসায় সুন্দর আড্ডা, লাঞ্চ করা কত্ত কত্ত মেমোরি।
সবার কাছে একটি জনপ্রিয় নাম। কিন্তু তিনি আমার কাছে, আমার ক্যারিয়ার জীবনে, আমাদের ফ্যামিলি জীবনের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। বটগাছ যেমন পথিককে ছায়া দেয়, তেমনি তিনি আমাকে ছায়া দেন। সবসময় আলোর পথের কথা বলেন। এই গুণী মানুষটার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। দেখেছি তার বিনয়, ধৈর্য আর পরিশ্রম। আমার ক্যারিয়ার এর জীবনে কিছু ভাল মানুষের আশীর্বাদের হাত মাথার উপর ছিল, আছে। তিনিও তাদের মধ্যে একজন এবং অন্যতম একজন ভালো বন্ধু।
মাহফুজ আহমেদের কাছে আমি ঋণী, কৃতজ্ঞ। এই কথা গুলো আমি তাকে শোনানোর জন্য কখনই বলিনি। আমি আমার আনন্দের জন্য, কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই বলি, ভালো লাগে। মন বড় হয়। মৃত্যুর পরেও এই কথা বলতে চাই বার বার। তিনি আমার চলার পথের গাইড।
এই মানুষটার মন অনেক নরম। কিন্তু প্রয়োজনে তিনি কঠিন হতে পারেন। মানুষের পিছনে লাগা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। যে কোন এতিম বা অসহায় বাচ্চাদের তিনি না জানিয়ে প্রতি বছর সাহায্য করেন যা অনেকেই জানেন না। তিনি সত্যি একজন মুগ্ধ করা মানুষ! মানুষকে সম্মান করেন, পুরোনো সব মনে রাখেন। কিছুই ভোলেন না।
আজ এই প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। অভিনন্দন তার গর্ভধারিণী মাকে। তার প্রতি রইল অভিনন্দন। শুভ কামনা চাই সুস্থতা।
মাহফুজ আহমেদকে কাছ থেকে দেখছি ৩৫ বছর। একটা কথা আমি সবসময় বলি আর বিশ্বাস করি। “কাউকে ছোট করে কেউ বড় হয়না। কাউকে বড় করলেই নিজে বড় হয়। কাউকে বড় করতে পারার ভিতরেই যত আনন্দ। তাতে মন বড় হয়।”
কোন একটা কথার রেশ ধরে মাহফুজ আহমেদ আমার চেয়েও একটা দারুণ সুন্দর কথা বললেন। তিনি বললেন, “আমাকে বড় করার জন্য তো তুমি কাউকে ছোট করতে পারোনা। অর্থাৎ একজনকে বড় করতে গিয়ে আরেক জনকে ছোট করা অন্যায়, ঠিক না। এতে তার চরিত্র এবং পরিবার বোঝা যায়।” সত্যিই খুব সুন্দর আর পারফেক্ট একটা কথা। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মনে থাকবে আমার। আর আমি তা বিশ্বাস করতে চাই। বিশ্বাস করি। আমার আশে পাশের মানুষ গুলো যদি তা মেনটেইন করে জীবন আরও সুন্দর হয়। জীবনে কখনই কাউকে ছোট করে কথা বলিনি। প্রকাশ্যে তো নয়ই।
এই চমৎকার মনের মানুষটির সহধর্মিণী ইশরাত জে কাদের মানে আমাদের মিমি ভাবি আরও অনেক বেশি চমৎকার। বলতে গেলে আমি তার পারসোনালিটির ফ্যান। মিমি ভাবির সৌন্দর্য, তার ব্যবহার, তার রুচি, তার পড়াশোনা, তার জানার ভাণ্ডার সব কিছুই আলাদা সবার চেয়ে। যা আমার অনেক পছন্দ। তিনিও সব সময় আমার কাজে উৎসাহ দেন। তার ব্যাবহার, ভদ্রতাবোধ, ব্যক্তিত্ব বলে দেয় কত বড় পরিবারে তার বেড়ে ওঠা!
এই প্রিয় মানুষ দুজন দীর্ঘ ২১ বছর এক সাথে পথ চলেছেন। এত বছরে তারা সুখ দুঃখের সাথি। চলতে চলতে কত মান অভিমান, ভালোবাসা, আনন্দ! তাদের দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধাবোধ তাদের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে। অনেক কিছু শেখার আছে তার প্রতিও। তাদের জন্য রইল অনেক শুভ কামনা আর ভালোবাসা। সারা জীবন যেন একসাথে পথ চলতে পারে, তাদের সন্তানদের যেন সুন্দর করে মনের মত করে মানুষ করতে পারে, আর আরাধ্য আর অরিত্র যেন চিরসুখী হয় তাদের মা বাবাকে নিয়ে। হাসি আর খুশি নিয়ে যেন তাদের জীবন কেটে যায়। এই প্রার্থনা আমার এই আজকের দিনে।
মাহফুজ আহমেদ আর মিমি ভাবী, তোমাদের অনেক ভালোবাসি আমি। ভালো থেকো,সুন্দর থেকো। আর আবারও শুভ জন্মদিন মাহফুজআহমেদ। যার ঋণ এই জনমে শোধ হবে না।
আমি পৃথিবীতে থাকি আর না থাকি মাহফুজ আহমেদ থাকবেন তার সুন্দর কাজ, তার জনপ্রিয়তা, তার দারুণ নির্মাণের জন্য। “সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে”
মাহফুজ আহমেদকে শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি।
আমি স্বপ্ন দেখি তিনি একদিন সিনেমা নির্মাণ করবেন, যেই সিনেমা সারা পৃথিবীর দর্শক নন্দিত হবে। সবাই বলবে “একজন মাহফুজ আহমেদ, তিনি বাংলাদেশের পরিচালক। চলো তার সিনেমা আবার দেখে আসি। তিনি আমাদের গর্ব।”
আর এই মানুষটির আগে আমি যদি না ফেরার দেশে চলে যাই, এই পৃথিবী থেকে, সেইদিন মাহফুজ আহমেদ বলবেন, “”আহারে একজন কাজ পাগল মানুষ ছিল, যে ভালবেসে কাজ করত, কাজকে ভালবাসতো, আমাকে ভালবাসতো। আমার পরিবারকে ভালোবাসতো। যার মন ছিল কৃতজ্ঞতায় ভরা।””
সুস্থ থেকো,সুন্দর থেকো। আবারও শুভ জন্মদিন। শুভ কামনা,প্রার্থনা… প্রহেলিকা দিয়ে তিনি শুরু করছেন, ওটিটি তে ‘অদৃশ্য’ করেও নিজেকে এই সময়ে প্রমাণিত করেছেন। প্রার্থনায় রাখবেন এই জনপ্রিয় এবং শক্তিমান অভিনয়শিল্পীর জন্যে। একজন চয়নিকা চৌধুরী চায় এই গুণী অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে সামনে আরো কাজ করতে। শুভ কামনা সব সময়।