যেকোন দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জন, বহুলাংশে নির্ভর করে সেই দেশের শিল্পয়ায়নের অগ্রগতির ওপর। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই জ্ঞানভিত্তিক শিল্পায়নের অভিযাত্রা জোরদার এবং ভবিষ্যৎ বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার সময় দেশটিকে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অংশ ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। শিল্প ও পরিষেবা খাতের অংশ ছিল খুব ছোট। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অংশ এখন ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে শিল্প ও সেবা খাতের অংশ যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ৫৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে শিল্পায়নের বিকাশ। আর সে বিকাশে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে সরকারের নীতি সহায়তা এবং ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ। বিশেষত আওয়ামীলীগ সরকারের বিগত পনের বছরের শাসনামলে শিল্পায়ন বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করে গুণগত শিল্পায়নে দেশের অগ্রগতি অত্যন্ত বলিষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ঔষুধ, ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ঔষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম কুড়িয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২১-২৫) রপ্তানিমুখী শিল্প উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শূন্য দশকের গোড়ার দিকে সরকার কয়েকটি শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ খাত (থ্রাস্ট সেক্টর) হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এর মধ্যে আছে সফটওয়্যার এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা এবং জাহাজনির্মাণ। রপ্তানিমুখী শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করেছে।
তৈরি পোশাকশিল্প
বাংলাদেশে শিল্পায়নের সাফল্যের কথা বলতে গেলে রপ্তানিমুখী, তৈরি পোশাকশিল্পের কথাই সবার আগে চলে আসে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বস্ত্র খাতে রপ্তানি আয় ২০১৯-২০,২০২০-২১ ও ২০২১-২২ (মে/২২ পযর্ন্ত) অর্থবছরে যথাক্রমে ৮৩%, ৮৪.৪২%, ৮৪.৪৯% ছিলো। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য ২০২৩ এর আগস্ট মাসে বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়েছে ৪০৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। যা ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ৩৭৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার ইউএস ডলার। অর্থাৎ, ২০২২ সালের আগস্ট মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে রপ্তানি বেড়েছে ২৯ কোটি ৯১ লাখ ইউএস ডলার বা ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা করেছে তৈরি পোশাকশিল্প খাত।
আইসিটি খাত
সম্প্রতি ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের আইটি শিল্প ১০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় তথ্য বাতায়ন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ জানিয়েছেন, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটিইএস) খাতের রপ্তানি আয় ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ওষুধ শিল্প
বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি কারখানা নিয়মিতভাবে ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে। এসব কারখানায় প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। যা দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সব ধরনের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। আর এসব উৎপাদিত ওষুধপণ্য বিশ্বের প্রায় ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত বাংলাদেশে ওষুধের বাজারের আকার ছিল ৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত ১ দশকে বাজার ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এটি ৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করছে প্রায় ৪৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল। এছাড়া দেশের ২৮৪টি ইউনানি ও ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ৭১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩১টি হার্বাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করছে।
২০০৯ হতে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্য অর্জন
২০০৯ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ১৫ হাজার ৫’শ ৬৫ দশমিক ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য খাতে অর্জিত রপ্তানি আয় ৫৫ হাজার ৫’শ ৫৮ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশী। আবার, ২০০৮-২০০৯ সময়ের তুলনায় পণ্য খাতে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ২’শ ৫৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে মোট ১৯৪টি দেশে ৬৬৮টি পণ্য রপ্তানি হলেও ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বিশ্বের মোট ২১০টি দেশে ৮০৬ টি পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। রপ্তানি আয় ও রপ্তানি দেশ/পণ্যের সংখ্যা পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে রপ্তানি আয় সর্বোচ্চ হয়েছে এবং সবচেয়ে বেশী দেশে এবং বেশী সংখ্যক পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে।
সরকারের উদ্যোগ সমূহ
১৯৯৯, ২০০৫ ও ২০১০ এর শিল্পনীতিগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততাকে বাড়ানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছিল। এই নীতির একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণ। এ ছাড়া শিল্প খাতের রপ্তানিমুখীকরণ, শিল্পের প্রতিযোগিতার উন্নতি এবং শিল্প উন্নয়নের জন্য সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল, যাতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপিতে) এই খাতের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যায়। শিল্পায়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকা, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার সংস্কার, বাণিজ্য উদারীকরণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়ন, শিল্পায়নের সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনশীলতা এবং পণ্যের মান বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির ওপর জোর দিয়ে শিল্পনীতি ২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী নীতির ধারাবাহিকতা হিসেবে, শিল্পনীতি ২০১৬-এর লক্ষ্য ছিল স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রচারের জন্য আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প স্থাপন করা।
একটি কার্যকর বাণিজ্যনীতি ছাড়া একটি সফল শিল্পায়ন সম্ভব নয়। তাই আমরা দেখতে পাই, শিল্পনীতিগুলো ক্রমে বাণিজ্যনীতির সঙ্গে পরিপূরক হয়েছে। বেশ কিছু বাণিজ্যনীতি সংস্কারের পর বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্য, বিনিময় হার, মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত আছে। রপ্তানি উন্নয়নের জন্য রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার পরিকল্পনা করা, রপ্তানির গুণমান উন্নত করা, উচ্চ মূল্য সংযোজন রপ্তানিকে উদ্দীপিত করা, সংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ধরনের সংস্কারগুলো তৈরি পোশাকশিল্প খাতসহ বেশ কটি খাতের জন্য উপকারী ছিল। এসব সংস্কারের মধ্যে ছিল রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কমুক্ত উপকরণ আমদানি, ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনা, যেমন আয়করের ওপর ছাড় এবং আমদানিকৃত মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক রেয়াত প্রদান।
অবকাঠামোগত ঘাটতি কমানোর প্রয়াসে সরকার বেশ কিছু বড় প্রকল্প সম্পন্ন করেছে, কিছু চলমান। পদ্মা বহুমুখী সেতু এসব উদ্যোগের মধ্যে একটি, যা বিভিন্ন উপায়ে অর্থনীতির দক্ষতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও বিদ্যমান সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়ন, নতুন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও আগের বন্দরগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে বর্তমান সরকার। একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি চালুও হয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য এসবের দ্রুত সমাপ্তি প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে নিরলস কাজ করছে সরকার।