২০১৮ সালের প্রতিশোধ ’২২-এ নেবে, নাকি রিয়াল মাদ্রিদের কাছে আরেকটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খোয়াবে লিভারপুল? মহারণ ঘিরে প্রশ্নের অন্ত নেই। শক্তিমত্তায় কাছাকাছি দুটি দল, কিন্তু পরিসংখ্যান-ঐতিহ্যে বিস্তর ফারাক। লিভারপুল যেখানে খোঁজে সপ্তম শিরোপার, রিয়াল সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি বার্নাব্যুর জাদুঘরে জমানোর অপেক্ষায়।
সব হিসেব-নিকেশ ছাপিয়ে ইউরোপসেরার মঞ্চ অপেক্ষায় জমজমাট এক ফাইনালের। একদিকে কার্লো আনচেলত্তি, অন্যদিকে ইয়ূর্গেন ক্লপ। কারা হতে চলেছেন এবারের ইউরোপসেরা, পরিসংখ্যান-ইতিহাসই বা কার পক্ষে বলছে?
শিরোপার লক্ষ্যে লা লিগা চ্যাম্পিয়ন অথবা প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় শীর্ষ দলটিকে ছাড়িয়ে যেতে হবে একে-অন্যকে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শনিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় মাঠে গড়াবে মহারণ। অভিজ্ঞতা-সমীকরণ টানলে অলরেডদের থেকে ঢের এগিয়ে ব্লাঙ্কোসরা।
প্রতিযোগিতাটিতে দুইবার ফাইনালে মুখোমুখি দেখায় অবশ্য একটি করে জয় দুদলেরই। ১৯৮১ সালে ১-০ ব্যবধানে জিতেছিল লিভারপুল, ক্লপের দলটিকে ২০১৮ সালে হারিয়ে দিয়েছিল সাদা জার্সির ব্লাঙ্কোস দল।
রিয়ালের তিন স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা, রদ্রিগো ও ভিনিসিয়াস জুনিয়র যেমন দুর্দান্ত ফর্মে, তেমনি নিজেদের শক্তিমত্তায় পুরো বিশ্বাস রাখছেন মোহাম্মেদ সালাহ, সাদিও মানে ও রবের্তো ফিরিমিনোরা। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ফাইনালের বিষয়টিও মাথায় রাখছে ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব দুটি।
ইউরোপসেরার মুকুট অর্জনের দিক থেকে যোজন এগিয়ে লস ব্লাঙ্কোস দল। এই মঞ্চে সর্বোচ্চ সফল দল মাদ্রিদ রাজারা, এপর্যন্ত ১৩ বার শিরোপা উদযাপনে মেতেছে। স্প্যানিশ জায়ান্টরা এপর্যন্ত ১৬ বার ফাইনাল খেলেছে। হারের তিক্ত স্বাদ পেয়েছে সবে তিনবার। অন্যদিকে নয়বার ফাইনালের মঞ্চে উঠে ৬টি জয় ও তিনটিতে হেরেছে লিভারপুল।
ইউরোপিয়ান কাপ অথবা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপার মঞ্চে মুখোমুখি হওয়ার আগে নয়বার দেখা হয়েছে দুদলের। সেখানেও এগিয়ে স্প্যানিশ জায়ান্ট দলটি। ১৯৮১-২০০৯ সালের মাঝে তিনটি ম্যাচ জিতেছিল লিভারপুল। এরপর এপর্যন্ত আরও পাঁচবারের দেখায় একটিতেও জয় পায়নি অলরেডরা। একটি ড্র করে বাকি চারটিতেই মেনেছে পরাজয়। এরমাঝে বড় ক্ষত হয়ে আছে ২০১৮ সালে ৩-১ ব্যবধানে ফাইনালে হার।
নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ইউরোপসেরার মঞ্চে সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলার রেকর্ডও গড়বে রিয়াল-লিভারপুল। প্রতিপক্ষ বিচারে সর্বোচ্চ ৯ বার রিয়ালের বিপক্ষে ডাগআউটে থাকবেন অলরেড বস ক্লপ। সাফল্যের বিচারে তিনটি জয়, দুটি ড্র ও চারটি হার পাওয়া ক্লপ আছেন অনেকখানি পিছিয়ে (৩৩%)।
টুর্নামেন্টের ইতিহাসে কোচ হিসেবে সর্বাধিক চারবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার সামনে আছেন আনচেলত্তি। ২০০২-০৩ ও ২০০৬-০৭ মৌসুমে এসি মিলানকে জেতানোর পর ২০১৩-১৪ মৌসুমে বর্তমান ক্লাবের হয়ে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিলেন। ২০০৪-০৫ মৌসুমে লিভারপুলের বিপক্ষে ফাইনালে একমাত্র হার দেখেছিলেন এ ইতালিয়ান। শিরোপার মঞ্চে সেবার আনচেলত্তির মিলানকে পেনাল্টিতে হারিয়েছিল অলরেডরা।
এই মঞ্চে খেলার দিক থেকেও অনেক এগিয়ে ব্লাঙ্কোসদের ডেরা। মাদ্রিদের টনি ক্রুস, করিম বেনজেমা, লুকা মদ্রিচ, মার্সেলো এবং ডেভিড আলাবা শতাধিক ম্যাচ খেলেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে লিভারপুলের হয়ে জেমি ক্যারেগার (৮০), স্টিফেন জেরার্ড (৭৩) ও ফিল নেইলের (৫৭) পর অর্ধশত ম্যাচ খেলার সামনে রয়েছেন জর্ডান হেন্ডারসন। আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো, থমাস মুলারের পর সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে তৃতীয় ফাইনালের লড়াইয়ে নামার রেকর্ড গড়ে ফেলবেন টেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ড।
২০১৭-১৮ মৌসুমের পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অলরেডদের হয়ে ৩৩ গোল ও ১১ এসিস্ট করেছেন সালাহ। মিশর স্ট্রাইকারের থেকে উপরে আছেন শুধু দুজন, বায়ার্ন মিউনিখের রবার্ট লেভান্ডোভস্কি (৫৫) ও পিএসজির কাইলিয়ান এমবাপে (৪৭)। এই সময়ে ৩০-এর অধিক গোল ও দশের বেশি এসিস্ট করার তালিকায় দ্বিতীয়জন তিনি। তালিকায় অন্যজন হলেন সাবেক বার্সা ও বর্তমান পিএসজি ফরোয়ার্ড লিওনেল মেসি।
প্যারিসের ফাইনালে দারুণ কয়েকটি রেকর্ডের সামনে আছেন ব্লাঙ্কোস অধিনায়ক বেনজেমা। ম্যাচের দিন ফ্রেঞ্চম্যানের বয়স হবে ৩৪ বছর ১৬০ দিন, ওইদিন তিনি গোল করতে পারলে পাওলো মালদিনির (৩৬ বছর ৩৩৩ দিন) পর নিজের নাম লেখাবেন সবচেয়ে বেশি বয়সী গোলের কাতারে। ২০০৫ সালে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে লিভারপুলের বিপক্ষে গোল করেছিলেন সাবেক এসি মিলানের তারকা।
চলতি মৌসুমে ১১ ম্যাচে ১৫ গোল পেয়েছেন বেনজেমা, ফাইনালে আর দুবার জালের দেখা পেলেই ধরে ফেলবেন এক সময়ের সতীর্থ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একার করে রাখা রেকর্ড। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে (২০১৩-১৪) সর্বোচ্চ ১৭ বার বল জালে জড়িয়ে ইউরোপিয়ান মঞ্চে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ধরে আছেন পর্তুগিজ মহাতারকা।
ফাইনালে একটি গোল করতে পারলে লেভান্ডোভস্কির ৮৬ গোল ছাপিয়ে সর্বাধিক গোল করার তালিকায় তিনে আসবেন বেনজেমা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এই রেকর্ডে ১৪০ গোল নিয়ে সবার উপরে রোনালদো এবং ১২৫ গোল করে দুইয়ে আর্জেন্টাইন মহাতারকা মেসি।
পরিসংখ্যান, লড়াই কিংবা প্রতিশোধ— অলরেড বা ব্লাঙ্কোস, কোনো দলই কাউকে এতটুকু ছেড়ে কথা বলতে নারাজ। প্যারিসে মহারণ প্রস্তুত, প্রস্তুত পরিবর্তিত মঞ্চও, এখন অপেক্ষা শনিবার রাতে খেলা মাঠে গড়ানোর। সালাহর লিভারপুলকে আবারও কাঁদিয়ে ইউরোপসেরার শিরোপা তালিকা বাড়িয়ে নেবে বেনজেমার রিয়াল, নাকি জমানো ক্ষোভের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে অলরেডদের সপ্তম শিরোপা এনে দেবেন সালাহ-মানেরা, উত্তর পেতে অপেক্ষা আর মাত্র একটা দিনের।