চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাতব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে প্রথাগত ধারণা রয়েছে যে শুধুমাত্র গিটে গিটে ব্যথাই বোধ করা বাতব্যথার একমাত্র লক্ষণ এবং আরেকটি বদ্ধমূল ধারণা এই বাতরোগ শুধুমাত্র প্রবীণ বা বয়স্কদেরই হয়ে থাকে, অন্য কারো নয়। এই লেখায় শিশু থেকে প্রৌঢ় সকল বয়সে বাতব্যথার বয়স ভিত্তিক কারণ বিশ্লেষণ, ব্যথাসহ আরও যে বিচিত্র ধরণের লক্ষণাদী হয়ে থাকে সেগুলো উল্লেখপূর্বক এসব জটিল রোগের আধুনিক চিকিৎসা ও সেগুলোর প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। 

প্রথমে এটা জানা প্রয়োজন যে বাতবিজ্ঞান (রিউমাটোলজির) ভিত্তি কি? এক কথায় বললে, এটি কঠিন শোনাবে তাই একটি সাধারণ বিষয় আগে বলা উচিত, মানব শরীরে বহিরাগত কোন রোগজীবাণু যেমন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে, শরীরের প্রহরীকোষ বা বিপদ সংকেত ব্যবস্থা সেটি টের পায় এবং এসবের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে রক্তে “এন্টিবডি” নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে যা এসব জীবাণু কোষ বা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে আমাদের এসব ইনফেকশন বা সংক্রামক ব্যধি থেকে রক্ষা করে।

এখন জীবাণু প্রতিরোধী এসব উপকারী এন্টিবডি শুধুমাত্র শরীরে প্রবেশকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল থাকার কথা। কিন্তু জিনগত ত্রুটির কারণে বা শরীরে কোন দীর্ঘমেয়দি দূষক বা জীবাণু প্রবেশের ফলে উপকারী ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ধরনের এন্টিবডিগুলো শরীরের সুস্হকোষ যেমন, অস্হিসন্ধি, মেরুদন্ড, রক্তনালী, স্নায়ু, লালাগ্রস্হি, ফুসফুস, কিডনি, ত্বক এমনকি মস্তিষ্ক ও চোখ আক্রমণ করে এবং প্রদাহ তৈরি করে।

এই প্রদাহের ফলেই মূলত গিটে ব্যথাসহ অন্যান্য লক্ষণ তৈরি হয়। এর ফলেই  অস্থিসন্ধির নড়ন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেখানে আনুষঙ্গিক গাঠনিক উপাদান হিসেবে যে লিগামেন্টগুলো থাকে সেগুলোতেও প্রদাহ ছড়িয়ে পড়ে। এরুপ ঘটনাকে বলে অটোইমিউন রোগ বা শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজের বিরুদ্ধে নিজেই কাজ করে ধ্বংসলীলা ঘটাচ্ছে এবং অঙ্গসমূহে অতিরিক্ত প্রদাহ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ব্যথাসৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ বাড়িয়ে দিয়ে শারীরিক কষ্ট বা লক্ষণ সৃষ্টি করে।

অটোইমিউন কারণে সৃষ্ট বাতরোগগুলোর নাম, বয়স ও লক্ষণ:

 গেঁটেবাত বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাত-পা- কব্জি বা গোড়ালী সন্ধিগুলোর ব্যথা থাকে জোড়ায় জোড়ায়, ধীরে ধীরে হাত-পা নড়াচড়া করে সচল করলে ব্যথা হ্রাস পায়। এছাড়াও হাত-পা এ ঝি-ঝি অনুভূতি হতে পারে, চোখে প্রদাহ বা লাল হতে পারে, এমনকি করোনারী প্রদাহের ফলে হৃদরোগ পর্যন্ত হতে পারে।

এই রিউমাটয়েড বাত কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী থেকে মধ্যবয়স বা বৃদ্ধবয়স যেকোন বয়সে হতে পারে। আবার কৈশোরে এইবাত হলে একে বলে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস।

 রিউমাটিক জ্বর বা বাতজ্বর: শিশুবয়সে সাধারণ ঠান্ডালাগা বা গলাব্যথার ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন থেকে ভুলভাবে এন্টিবডি তৈরি হয়ে যে জ্বর হয় এবং এরফলে বিশেষ ধরনের যে গিটেব্যথা হয় তাকে বলে বাতজ্বর বলে। এটি কিন্তু রিউমাটয়েড বা গেঁটেবাতের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এরফলে হার্ট ভালবের সমস্যা বা কিডনি জটিলতা হতে পারে।

এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস: কোমরের মেরুদন্ডের প্রদাহজনিত বিশেষ বাত বা কটিবাত। এটি যুবক বয়সে ২০-৩০বছর বয়সী পুরুষদের কোমরব্যথার কারণ যা বিশ্রাম নিলে বেড়ে যায় এবং পরিশ্রম করলে হ্রাস পায়।

 দীর্ঘমেয়াদি আমাশয় বা যৌনবাহিত ইনফেকশনজনিত বাত: পরিপাকনালীর প্রদাহের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া বা ইনফেকশন জনিত আমাশয়ের পরে এক ধরনের বাত সৃষ্টি হয়। আবার, যৌনবাহিত ইনফেকশন যেমন, গনোরিয়ার পর একই ধরনের গিটেব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।

চর্মরোগজনিত বাত: ত্বকের বিশেষ প্রদাহ বা চুলকানি জনিত রোগ সোরিয়াসিস এর ফলেও বাত সৃষ্টি হয়ে গিটেব্যথা হতে পারে।

লুপাস বা নারীদের বিশেষ বাত: গিটেব্যথাসহ সূর্যালোকে বাইরে গেলে মুখে- গালে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, মুখের ঘা, চুল পড়া, বার বার সন্তান গর্ভধারণ হলেও দু-তিন মাস পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া, কিডনীর সমস্যা এসব বিচিত্র লক্ষণ নিয়ে নারীদের যে বাত হয়, তাকে লুপাস বলে।

 এন্টি ফসফোলিপিড সিনড্রোম: বার বার সন্তান গর্ভধারণ হলেও দু-তিন মাস পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া, পা এর ত্বকে বিশেষ ধরনের ঘাসহ অতিরিক্ত রক্তজমাট বেঁধে যাবার প্রবণতা দেখা যায়।

সিস্টেমিক স্ক্লেরোসিস: হাত-পা-মুখের ত্বক টান টান হয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া, ফুসফুসের প্রদাহ হয়ে করোনার মতো ফুসফুস শক্ত হয়ে যাওয়া, কিডনি সমস্যাসহ যে বাত হয় তা সিস্টেমিক স্ক্লেরোসিস বলে।

 জোগ্রেন সিনড্রোম:  মুখের লালা শুকিয়ে যাওয়া, চোখের পানি-ঘাম এসব প্রাকৃতিক তরল শুকিয়ে গিয়ে শুষ্কতা জনিত যে বাত হয় তাকে বলে জোগ্রেণ রোগ।

ডার্মাটোমায়োসাইটিস বা পলিমায়োসাইটিস: ত্বক বা মাংসপেশীর প্রদাহ হয়ে ত্বকে বিশেষ ঘা দেখা যায় এবং শরীরের পেশীতে ব্যথা হয়ে এই বাত হয়।

এরূপ অটোইমিউন কারণ ছাড়াও-

  • শরীরের বিশেষ পুষ্টি উপাদান যেমন ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হয়ে হাড়ক্ষয় হয়ে বাতব্যথা সৃষ্টি হতে পারে যেমন, অস্টিওপরোসিস। একারণে শুধু যে ব্যথা হচ্ছে তা নয় হাত-পা ঝি-ঝি করা, জ্বালাপোড়া হওয়া, নিদ্রাহীণতা এমনকি স্মৃতিভ্রংশ পর্যন্ত হতে পারে।
  • আবার বিশেষ ধরনের বর্জ্যপদার্থ যেমন ইউরিক এসিড শরীর থেকে নিষ্কাশন না হতে পারার জন্য বর্জ্যপদার্থ অস্হিসন্ধিতে জমা হয়ে বাতের কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে খাদ্যভ্যাসও দায়ী যেমন, অতিরিক্ত ডাল, বিচি জাতীয় খাবার, সামদ্রিক খাবার, গরুর মাংস গ্রহণের ফলে ইউরিক এসিড সৃষ্টি হয়। যেমন, গাউট।
  • আবার, সাধারণভাবে মেরুদন্ডসহ যেকোন অস্হিসন্ধিতে আঘাত বা অতিরিক্ত ভারত্তলোন বা  অবস্থানগত ত্রুটির জন্য স্বাভাবিক নড়াচড়া বাধাগ্রস্ত হয়ে, দুইহাড়ের মধ্যবর্তী নরম ডিস্ক সরে গিয়ে বা লিগামেন্টে প্রদাহ সৃষ্টি হয়েও বাতব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, পি এল আই ডি(সায়াটিকা) বা টেনডিনাইটিস বা বার্সাইটিস। এর ফলে পায়ের রগ বা স্নায়ুসমস্যা হতে পারে যেমন, রগে টান অনুভূত হওয়া, ঝিনঝিন করা বা পিন ফোটানোর মতো অনুভূতি.।