অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, ‘দেশে প্রত্যক্ষ কর রাজস্বের গড়ে ৫০ শতাংশ উৎস করের মাধ্যমে আহরিত হয়, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বেশ কম’। মিথ্যা এবং ভুল হিসাব বিবরণী দাখিল করে যে ব্যবসায়ী সমাজ কর ফাঁকি দিয়ে আসছে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করে রাষ্ট্রের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম কার্যকর উপায় হচ্ছে উৎসে কর কর্তন।
আয়ের উৎসে করাদায় বাড়ানোর জন্য ২০১৬-১৭ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে রফতানী আয়ের উপর ১.৫% উৎসে কর কর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে যা বর্তমানে ০.৬%। এ প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। সুশীল সমাজের অর্থনীতিবিদেরাও সুর মিলিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ব্যবসায়ীদের মালকানাধীন সংবাদ মাধ্যম এ বিষয়টিকে সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে ব্যাপকভাবে প্রচারের মাধ্যমে।
উৎসে ১.৫% কর কর্তন বাস্তবে নীট মুনাফার কত শতাংশ হয় তা একটি সাধারণ অংক করে বেড় করে ফেলা যায়। ধরি, একটি রফতানীকারক প্রতিষ্ঠান বছরে ১০০ টাকা রফতানী থেকে আয় করে। তাহলে প্রস্তাবিত উৎসে কর কর্তনের আইন অনুযায়ী তার কাছ থেকে সারা বছরে কর কেটে নেয়া হবে ১.৫০ টাকা। অন্যদিকে, মনে করি, রফতানীকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে নীট লাভ করে ২০% হারে। পোশাক শিল্পের হিসাব রক্ষণের কাজে জড়িত এমন বেশ কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি তাদের করযোগ্য মুনাফার পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি। শেয়ার বাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানিগুলোকে আয়কর দিতে হয় ৩৫% হারে। তাহলে ঐ প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক আয়কর হবে (১০০ টাকা x ০.২০% x ০.৩৫%) ৭ টাকা। অর্থাৎ উৎসে ৭% পর্যন্ত কর কর্তনের সুযোগ রয়েছে। এই ৭ টাকার মধ্যে যখন রফতানীকারক এলসি’র মাধ্যমে রফতানী আয় নিজের ব্যাংক একাউণ্টে জমা হবে তখন সরকার ১.৫ টাকা কেটে রাখবে। বছর শেষে আয়কর বিবরণী জমা দেবার সময়ে তাকে বাকী ৫.৫০ টাকা জমা দিতে হবে।
ব্যবসায়ী নেতারা উৎসে কর কর্তনের হার বাড়ানো হলে ব্যবসায় বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে, হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হবে – এমন কথা বলছেন কেন? উৎস কর বাড়ানো হলে তাদের কী ক্ষতি হবে তা তারা বলছেন না বা বলার মত কিছু নেই বলে তারা অহেতুক জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন। উৎস কর বেশি দেয়ার মানে প্রদেয় আয়কর আয় বৎসর শেষ হওয়ার আগে আয়ের সময় কর প্রদান করা। অর্থাৎ এক অর্থে অগ্রীম প্রদান। বাস্তবে অগ্রীম প্রদানও নয় বরং যখন আয় তখন প্রদান। একে যদি অগ্রীম প্রদান হিসেবে বিবেচনাও করি তথাপি এই পদ্ধতি সারা দুনিয়ায় সর্বজনগ্রহীত উপায়।
অগ্রীম কর প্রদান কোনোভাবেই উৎপাদন খরচের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আয়করের দায় বর্তায় মালিকের উপর, মালিকের মুনাফার অংশ সরকারকে দিতে হয়, পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ে না। সুশীল অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীগণের হৈ চৈ এর কারণ অন্যকিছু, উৎপাদন খরচ বেড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতা শক্তি কমে যাওয়া নয়।
সুশীল অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীগণের হৈ চৈ এর কারণ ব্যবসায়ীদের নিট মুনাফার উপর কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে যাওয়া। উৎসে কর কর্তন ০.৬% থেকে ১.৫% করা হলে তাদের অতিরিক্ত ০.৯% কর বেশি প্রদান করতে হবে। রফতানীকারকদের এখন বেশি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। অর্থাৎ মিথ্যা হিসাব বিবরণী দিয়ে কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে যাবে। সাধারণভাবে সকলেই জানে যে অসাধু ব্যবসায়ীরা কয়েক রকমের হিসাব বিবরণী তৈরি করে থাকেন। এর একটা তারা জমা দেন ব্যাংকে যেখানে বেশি মুনাফা এবং বেশি সম্পদ দেখানো হয় বেশি বেশি ঋণ পাবার আশায়। আরেকটা জমা দেয়া হয় আয়কর অফিসে যেখানে সামান্য কিছু মুনাফা দেখানো হয় (সুযোগ পেলে ক্ষতি দেখানো হয়) এবং কম সম্পদ দেখানো হয় যাতে কর কম বা না দিতে হয়। আরেক প্রস্ত হিসাব বিবরণী থাকে মালিকের জন্য যেখানে আয়-ব্যয় এবং সম্পদ সঠিকভাবে দেখানো থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা কম মুনাফা দেখিয়ে বিপুল অংকের কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। উৎসে কর কর্তন করা হলে এভাবে কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে যায়।
প্রবাসীদের মত রফতানীকারকেরা দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে থাকেন, লক্ষ লক্ষ লোকের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকেন। তাদের ব্যবসায়ীক সুবিধাদীর দেখভাল করা জনগণের হয়ে সরকারের দায়িত্ব। তাই বলে তাদের আয়কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তারা সঠিক পরিমাণ কর দেবেন এবং রাষ্ট্রের পক্ষে যেসব কাঠামোগত সুবিধাদী দেয়া সম্ভব তার ব্যবস্থা সরকার করবে, করছে।
এ লক্ষ্যে সরকার বেশকিছু সুবিধাদী রাষ্ট্র রফতানীকারকদের দিয়ে থাকে যেমন: অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং প্রিফেব্রিকেটেড বিল্ডিং উপকরণের উপর রেয়াতি সুবিধা এবং রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে ব্যবহার্য কাটিং টেবিলে মূলধনী যন্ত্রপাতির উপর কর রেয়াত, রফতানীকারকদের জন্য ইপিজেড, বণ্ডেড ওয়ারহাউস সুবিধা, রফতানীর জন্য আমাদানীকৃত কাঁচামালের উপর কোনো কর দিতে হয় না, কম সুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা, ইত্যাদি। প্রতিটি নাগরিকের যেমন করযোগ্য আয়ের উপর কর দেয়া নাগরিক দায়িত্ব তেমনি রফতানীকারকদেরও আয়কর দেয়া কর্তব্য।
দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়। ২০১৩ সালে যার পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘পানামা পেপারস’ এবং ‘অফশোর লিংকস’ থেকে জানা গিয়েছে যে, বাংলাদেশের ৫৬ জন ব্যক্তির নাম ঐ তালিকাগুলোতে রয়েছে। এখনো প্রকাশ হয়নি এমন আরও বহু লোকের বিনিয়োগ রয়েছে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্ট ৯৮টি ‘কর স্বর্গে’। কর ফাঁকি দিয়ে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা এই লোকগুলো কারা?
টাকা পাচারের তথ্য দেয়া ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংগঠন, জিএফআই বলেছে যত টাকা পাচার হয় তার ৮৩.৪% হয় বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যমে। বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যমে টাকা পাচারের সুযোগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে রফতানীকারকদের। এরা আন্ডার ইনভয়েসিং করে রফতানী আয়ের একটা অংশ দেশে আনে উৎপাদনের উপকরণের এবং কারখানা খরচ মেটানোর জন্য। এখানে কিছু মুনাফাও দেখানো হয়। যার উপর আয়কর তারা আয়কর দিয়ে থাকেন। বাকী অংশ তারা বিদেশে অবস্থিত ‘কর স্বর্গে’ জমা করে দেন। এভাবেই দেশ থেকে পাচার হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। এ টাকা দেশে আসলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ত, বেকার লোকদের কর্মসংস্থান হত, সরকার অধিক রাজস্ব আহরণ করতে পারত, আরও বেশি অবকাঠামো তৈরি করা যেত যা আবার অধিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করত। কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার দেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ। টাকা পাচারকারীদের কম হারে কর দেয়ার বিধান ন্যায্য নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের কর্পোরেট কর হার ৩৫% থেকে কমিয়ে ২০% করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কর্পোরেট আয়করের হার কেন কমানো হবে তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেট বক্তৃতায় নেই। তাদের উৎসে কর কর্তনের হার বাড়ানো হয়েছে যা অত্যন্ত যৌক্তিক। তাই বলে কি কর্পোরেট কর হার কমাতে হবে? এটা কোন রকমের ব্যালেন্সিং? অন্য যাই হোক না কেন, এটা যুক্তিগ্রাহ্য এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যালেন্সিং নয়। অন্যান্য ব্যবসায়ের মত এদেরও ৩৫% হারে আয়কর দেয়াই যুক্তিগ্রাহ্য এবং ন্যায় সঙ্গত।
তৈরি পোশাক শিল্প দেশকে অনেক কিছু দিচ্ছে এ কথা যেমন ঠিক ঠিক তেমনি দেশও তাদের অনেক কিছু দিয়েছে। গত শতাব্দীর ‘৮০’র দশক থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এই শিল্পকে নগদ সহায়তা (ক্যাশ ইনসেন্টিভ) থেকে শুরু করে এমন কোন আইনি বা রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেই যা এই শিল্পকে দেয়নি। তৈরি পোশাক শিল্প এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। সারা দুনিয়ায় একমাত্র চীন বাংলাদেশের থেকে বেশি তৈরি পোশাক রফতানী করে। ১২০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের পেছনে।
এই শিল্পে বাংলাদেশ এতটাই শক্তিশালী যে রানা প্লাজা ধ্বংসের পর আমদানীকারক দেশগুলোতে ব্যপক সমালোচনা হওয়ার পরেও বাংলাদেশের রফতানী কমেনি। বাস্তবে আমদানীকারকেরা বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল। দেশে আরও উন্নত মানের পণ্য তৈরী করে, আপন শক্তিতে ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে পোশাক শিল্পের মুনাফা বাড়াতে হবে; রাষ্ট্রকে কম কর দিয়ে নয়। রাষ্ট্রকে কম কর দিলে রাষ্ট্র দূর্বল থেকে যাবে। দূর্বল রাষ্ট্র তার ব্যাবসাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)