দেশজুড়ে আলোচিত বিষয় মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে কেন এই যাচাই বাছাই। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চরম মানহানি হচ্ছে এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভুয়া বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন উপজেলায় ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাগণের নামের তালিকা’ শিরোনামে উপজেলা কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার স্বাক্ষরিত চিঠি গিয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর। এ নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণের আগেই ভুয়া ঘোষণা ও ভুয়া ঘোষণার পর যাচাই-বাছাই! একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে হাজির করে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে উনি মুক্তিযোদ্ধা কি না। অন্যরা হাত নেড়ে বলছে, না-না, ভুয়া! এ নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে চরম অনৈক্য। অভিযুক্তরা হয়রানি হতে বাঁচতে যাচাই-বাছাই কমিটিকে ঘুষ দিতেও বাধ্য হচ্ছে অনেক জায়গায়। চলছে অভিযোগ ও অভিযোগ প্রত্যাহারের বাণিজ্য।
বিগত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে বিপক্ষ প্রার্থীকে ভোট দেয়া সহযোদ্ধাকে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে অভিযোগ দিয়ে হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। প্রকৃত অবস্থার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় পুরো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটিই ত্রুটিপূর্ণ। নেত্রকোনার মদন উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার স্বাক্ষরিত ও প্রেরিত অভিযোগপত্রে দেখা গেছে, বরাবর, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মদন, নেত্রকোনা লেখা রয়েছে। এই অভিযোগপত্রে ক্রমিক, নাম, পিতার নাম, গ্রাম, মুক্তিবার্তা নং, গেজেট নং, ভাতা উত্তোলনের হিসাব নম্বর ও মন্তব্যের কলাম রয়েছে। অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা মোট ২৭ জন। এতে কারও কারও মুক্তিবার্তা নং, গেজেট ও ভাতা উত্তোলনের হিসাব নম্বর এই তিনটিই রয়েছে। কারও মুক্তিবার্তা নং আছে, গেজেট নেই, আবার কারও গেজেট আছে মুক্তিবার্তা নং নেই। কারও মুক্তিবার্তা নং আছে গেজেট নেই ও ভাতা উত্তোলনের হিসাব নম্বর নেই। অভিযোগ পত্রের ২৬ ক্রমিকের নাম কলম দিয়ে কাটা। ২৭ ক্রমিকে উল্লেখিত জনের নাম কেটে কলম দিয়ে আবার আরেকজনের নাম সংযোজন করা রয়েছে। এখানে অনেক রণাঙ্গনে সক্রিয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নামও অভিযুক্তের তালিকায় এসে গেছে বলে জানা যায়। এছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এ নিয়ে নানা গুঞ্জন, ক্ষুব্ধতা ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দিয়ে সমাহিত করা হয়। ইতোমধ্যে যেসব মুক্তিযোদ্ধা আজকের এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যেও যে কেউ ভুয়া অভিযোগে অভিযুক্ত হতেন না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? তাদের মধ্যে ভুয়া থেকে থাকলে, তাদের গার্ড অব অনারওতো ছিল ভুয়া। ভুয়া ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেলেন কিভাবে? কে দিলেন তাদের সনদ? যারা দিলেন তারা কারা? তাদের কি খুঁজে বের করা উচিত নয় সবার আগে? গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজের সম্মানের উপর আঘাত করছে এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া। প্রতি জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা অভিযুক্ত আসামীর মত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও যাচাই-বাছাই কমিটির লোকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতো বছর ধরে মানুষ যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান করে আসছেন, আজ তারাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিশেষণে অপমানিত হচ্ছেন। ভুয়া চিকিৎসক, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া সেনা কর্মকর্তা ও ভুয়া শিক্ষা সনদধারীদের মতো দেশ জুড়ে আলোচিত হচ্ছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। এসব ভুয়া ব্যক্তিদের সরকার প্রদত্ত কোনো সনদ নেই। ভুয়া সনদধারী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার থেকে দেয়া সনদ থাকে। বড় অপরাধী কি সনদধারী, না সনদ প্রদানকারী? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেও অনেকেই সনদ পাননি, যেখানে সেখানে ভুয়া ব্যক্তিদের যারা সনদ দিলেন, সবার আগে তাদের বিচার কাম্য নয় কি? কে আসল, কে ভুয়া, চিনতে পারাটাই দায় হয়ে উঠেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও হয়ে উঠছেন সন্দেহভাজন। মানুষ বলতে শুরু করেছে, এরাই বুঝি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান! যাদের নাতি-পুতিরাও সম্মান পায়?
জেলা-উপজেলায় মাইকিং করে যাচাই-বাছাই কমিটি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য জানাচ্ছেন। আবার যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, বিচারপতি, তোমার বিচার করবে কে? আবার নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধা সংযোজনের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। আবার মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সংযুক্তিতে বয়স ১৩ বছর নির্ধারণ কেন অবৈধ নয়, এ ব্যাপারে হাই কোর্টে রিটও হয়েছে। আদালতের রায়ে অনেক জায়গায় যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া স্থগিত হয়েছে। এক কথায় গোটা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে, এক চরম হ-য-ব-র-ল প্রক্রিয়া। এতে উৎফুল্ল হয়ে বাঁকা হাসি হাসছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা, তারাই যদি বিতর্কিত হন, তাহলে কি স্বাধীনতা যুদ্ধের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক ভাতা নেন, ভাতা থেকে কিস্তি কাটার ভিত্তিতে অনেকেই ব্যাংক হতে ঋণও নিয়েছেন। ভুয়া প্রমাণিত হলে তাদের প্রাপ্ত ভাতা ও ঋণের সমাধান কিভাবে করবে সরকার। সেটি কি আদায় করা হবে নাকি মওকুফ করা হবে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সরকার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অথবা অনুদান নিয়ে বসত ঘর নির্মাণ করেছে। তাদের মধ্যেও অনেকের নামে অভিযোগ রয়েছে। এখন বলাবলি হচ্ছে, ভুয়া প্রমাণিত হলে, তাদের বসত ঘর নিয়ে নেবে সরকার। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার রয়েছে আতঙ্কে। আদালতের রায়ে কিছু উপজেলায় যাচাই-বাছাই বন্ধ রয়েছে। হয়তো এসব জেলায় অভিযুক্তরা পাড়ও পেয়ে যেতে পারে। ভুয়ারাও ভোগ করে যেতে পারে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্ত সম্মান ও সুবিধা। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজন হয়েছে ভারতীয় তালিকা, লাল বই, জাতীয় তালিকা ও গেজেটের অন্তর্ভুক্তি।
এসব তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের বিরুদ্ধেও ভুয়া পদ্ধতি অবলম্বনের অভিযোগ উঠেছে। তবে কি এসব তালিকাও ভুয়া ছিল? এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের চেয়ারপারসন আবির আহাদের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, আমরা বদ্ধমূলভাবে জানি যে, মুক্তিযুদ্ধে কাশিয়ানী উপজেলায় মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল আটশত। কিন্তু কি আশ্চর্য, বর্তমানে কাশিয়ানীতে তেরশ আশিজন মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পান। তাহলে দেখা যাচ্ছে কাশিয়ানী উপজেলায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে পাঁচশত আশি জনই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। কয়েকদিন আগে কাশিয়ানী উপজেলার একজন সাংগঠনিক কমান্ডার আমাকে জানিয়েছেন যে, চলতি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে নতুন আরো নয়শ জন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য আবেদন জমা দিয়েছেন! এখন বুঝুন বিষয়টা কী! অর্থাৎ সরকারি তালিকায় ইতোমধ্যে পাঁচশ আশি জন ভুয়া রয়েছে। আর এখন নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার আরও নয়শ জন।
আমার ধারণা, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় আনুমানিক ষাট/সত্তর হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আর চলমান মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রমে সারা দেশে আরও নাকি দেড় লক্ষ জন নতুন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য ইতোমধ্যে আবেদন পত্র দাখিল করেছেন! আমার ধারণা, এই দেড় লক্ষ আবেদনের মধ্যে শতকরা নিরান্নব্বই ভাগই ভুয়া। ‘এই চিত্র শুধু গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর নয়, সারা দেশেরই চিত্র এটি।
এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারীর তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় ২০০ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তাদের নাম ২০০৫ সনে গেজেটে উঠিয়েছেন। বাছাই কমিটিতে সেসব ভুয়ারাই ঠাঁই পেয়েছেন। এবারের যাচাই-বাছাইয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাড়বে বলেই মনে করছেন তারা। সম্মানি ভাতা বাড়ানো, চাকরি কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আগ্রাধিকার, বিশেষ ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদি প্রাপ্তির কারণেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার হিড়িক লেগে গেছে সারা দেশে। কাজেই এসব বন্ধ করা গেলে এই হিড়িক থামানো সম্ভব। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলেই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, আদর্শবান দেশপ্রেমিক হবেন এটা ঠিক নয়। এগুলো ভাববার সময় হয়েছে। আর দেশে এত এত বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকতেও মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর দেশ চুপসে গিয়েছিলো কেন? আর সামান্য কয়েকজন যারা এই হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের অনেকেরই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নেই। নেই কেন? সমস্যার শেকড় খোঁজা জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)