কিছু ছবি সামাজিকসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোরাঘুরি করছে। বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন ফটোগ্রাফাররা। এক্সক্লুসিভ ক্লিকের জন্য প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন। প্রশংসা করার মতই অবশ্য। ঠিক সময়ে ঠিক ক্লিক করতে পারাটা সহজ কাজ নয় বা সবার কম্মোও নয় ।
তবে সার্বিক পরিস্থিতি ও দৃশ্যপট বিবেচনায় এত এত প্রশংসার পরও ছবিগুলো আমার ভেতরে কোন আবেদন তৈরি করা তো দূরের কথা বরং জাগিয়ে দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ আর কষ্ট। বলা উচিত কি উচিত না ভেবে ভেবে কথাটা না বলে থাকা গেলো না। কিছু মানুষ এতে রুষ্ট হবেন, কিছু প্রিয় মুখ কঠিন হয়ে যাবেন। কিন্তু না বললে নিজের মনের উপর চাপ পড়ছে। বিষয়টা হয়তো যার যার দৃষ্টিভঙ্গি!
আর এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণেই হয়তো যাদের ফটোগ্রাফির এত এত প্রশংসা হচ্ছে তাদের আমি দেখছি শুধুই একজন তথাকথিত পেশাদার হিসেবে। কোনভাবেই বিবেকবান বা হৃদয়বান মানুষ মনে হচ্ছে না।
একটা তাজা প্রাণকে এভাবে চোখের সামনে এমন ভয়ঙ্কর করুণ পরিণতির দিকে চলে যেতে দেখেও উনাদের মনে আশঙ্কা, ভয়, মমতা … কোনরকম ভাবাবেগের সৃষ্টি হলো না!
উনারা যেন খুঁজছিলেনই কিছু এক্সক্লুসিভ শট যা দিয়ে বিখ্যাত হতে পারেন। অথচ এমন একটা দৃশ্য দেখে কোন মানুষের ক্যামেরায় ছবি তোলার কথা মাথায় আসার কথাই না! এমন একটা আকস্মিক ও মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব বরং একজন মানুষকে বোধহীন করে দেয়ার কথা। সেখানে বেশ চাতুর্য ও দক্ষতার সাথেই ঠাণ্ডা মাথায় তারা ক্লিকগুলো করেছেন। চাতুর্য শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণে যে একটা মানুষের করুণ মৃত্যুর চেয়েও ক্যারিয়ারে কয়েক ধাপ উপরে উঠে যাওয়ার গুরুত্বটা তখনও ওই অবস্থায়ও মাথায় ভালই খেলেছে।
যে মানুষটির মরে যাওয়ার এক্সক্লুসিভ শটগুলো তারা ধারণ করেছেন, তিনিও তো কারো বাবা, ভাই, স্বামী বা সন্তান। তার আপনজনেরা প্রতিটা মুহূর্ত রক্তাক্ত হবেন এই শটগুলো দেখে। জানেন কি দুর্ভাগা পরিবার কী পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছে?
বনানীর মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে আমার এক বন্ধু ও সহপাঠীকে হারিয়েছি। জীবন বাঁচাতে ক্যাবল বেয়ে নামতে গিয়ে প্রাণ হারায় সে। সৈয়দা আমেনা ইয়াসমীন রাতুল– সর্বদা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ও অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সবাই অসহায় ও শূন্য দৃষ্টিতে দেখলাম উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের পতন। আর আপনারা পেয়ে গেলেন এক্সক্লুসিভ কিছু শটস।
লাইভেও দেখালেন আপনারা যা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ইউটিউব জুড়ে আর প্রিয়জন হারানো আপনজনদের ঘা’ টাকে প্রতিনিয়ত আরো দগদগে করে দিচ্ছে। অথচ সম্পাদনা ছাড়া কোনো ফুটেজই প্রচার হওয়ার কথা না। ধরে নিলাম লাইভ, সেখানেও ক্যামেরা তাৎক্ষণিক ঘুরিয়ে নেওয়ার সম্পাদনা গুণ না থাকেল আপনি কিসের গণমাধ্যম! ক্যামেরাপার্সনদের সেইরকম ধারণা না দেওয়া সম্পাদকেরা কিসের সম্পাদক! যদি টেলিভিশন লাইভে তাৎক্ষণিক প্রচারও হয়ে যায় সেটা টাকা কামানোর জন্য ইউটিউব চ্যানেলে তুলে দেওয়া কোন সাংবাদিকতা!
কিংবা সেই সম্পাদকেরা যারা এক্সক্লুসিভের নামে ওই স্টিল ছবিগুলো প্রকাশ করেছেন, এরপর সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে। ক্যামেরাপার্সন হয়তো না বুঝেই ছবিগুলো তুলে ফেলেছেন। কিন্তু কোন আক্কেলে আপনারা সেগুলো পাবলিশ করলেন!
হতে পারেন আপনারা খুব বড় মাপের একেকজন ক্যামেরাম্যান-সম্পাদক । কিন্তু আপনাদের হৃদয়বান মানুষ কিছুতেই বলা যাচ্ছেনা, সরি। উনারা এক্সক্লুসিভ কাজের জন্য হয়তো পুরস্কৃত হতে পারেন, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে জাায়গা পাবেন না কোনদিনও। এগেইন সরি।
অথচ এমন সাংবাদিকের কথাও জানি যিনি যুদ্ধের ছবি তুলতে গিয়ে ক্যামেরা ফেলে রেখে আহত মানুষদের বাঁচাতে দৌড়াদৌড়ি করছেন যা ক্যামেরাবন্দী করেছেন অন্য আর একজন ফটোগ্রাফার। যে ছবি সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছিলো।
আবার এমন সাংবাদিকের কথাও পড়েছি যিনি এরকম সিচুয়েশনে এক্সক্লুসিভ শট নিয়ে পুরুস্কৃত হয়েছেন বটে, তবে সেই একই কাজের কারণে বিবেকের তাড়নায় ভুগেছেন আমৃত্যু।
সাংবাদিকতা কোন লোভনীয় পেশা নয়। এটা একটি মহান পেশা। সাংবাদিকতাকে সমাজের দর্পণ মনে করা হয়। সেই দর্পণকে সবার চোখের সামনে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেন একজন সাংবাদিক। কিন্তু দায়িত্বশীল একটি পেশাও সাংবাদিকতা। যা খুশি করার নাম সাংবাদিকতা নয়। এই পেশাটাকে কলঙ্কিত করবেন না দয়া করে।
দেখান যে আপনি শুধু একজন সাংবাদিক নন, একজন মানুষ, সংবেদনশীল মানুষ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)