চলছে ঝাড়পোঁছ। ধূলোর বিরুদ্ধে অভিযান। সেলফ থেকে সব বই মাটিতে। কাপড় দিয়ে মুছে ফেরত দিচ্ছি আগের জায়গায়। কিছু বই আলাদা হচ্ছে। আবার পড়বার তালিকাতে। হাতে পড়ল একটি কবিতার বই। শামসুর রহমানের কবিতার বই। মাঝের দিক থেকে বই খুলি, চোখ পড়ে পাতায়।
কবিতার নাম ‘সুধাংশু যাবে না’।
পাগলামী করিস নে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিস নে বন্ধু, এখনই তুই পালা ।
জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশান সম বাস্তুভিটায়
সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা
কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা ।
আলাদা করে রাখা বইগুলি ঠেলে একপাশে সরিয়ে একটু জায়গা করি মেঝেতে। সোফার কুশন মেঝেতে নামাই। কুশনে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ি বইয়ের মাঝে, হাতে শামসুর রহমানের কবিতা। আবারো বইয়ের পাতায় চোখ,
আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
সেই একপাল বন্ধু গুলো রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে
প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা ।
আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশু
আড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্ক –
এই বাস্তুভিটার সাথে আর এক ঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা ।
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা ।
হাত পড়ে পাশের বইগুলির উপর তাকিয়ে দেখি, আলাদা ডাই করে রাখা বইয়ের মধ্যে আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বঙ্গবন্ধুর লেখা প্রথম বই, কারাগারের রোজনামচা, জেন মেয়রের ডার্ক মানি, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ট্রাম্প, দ্যা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, রিলিজিওন ইন আমেরিকান পলিটিক্স, অল দ্যা লাইট উই ক্যান নট সি, স্পিরিচুয়াল বাট নট রিলিজিওয়াস আর মোবাইল যুগে সাংবাদিকতা।
আবারো চোখ ফেরাই কবিতার পাতায়,
কোথায় সেই কল-কাকলীতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালী-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশু
দু’টি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালী ভিটায় ।
কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধু গুলা
ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা ।
তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশু
তোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ঐ ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’
কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবেঃ কোথায় চকলেট গুলা?
তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা।
ঢাকার রাস্তার ধারের দেয়ালে দেয়ালে লেখনী সুবোধ তুই পালা, খুব অবাক লাগে সুবোধদেরই কেন পালাতে হয়। রাজা আসে রাজা যায় সুবোধদের ভাগ্যরেখার নড়চড় নেই। শুধু রাতের আঁধারেই না দিনের আলোতেও সুবোধদের চলে যেতে হচ্ছে, শুধু প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, নিজের চৌদ্দ পুরুষের দেশ ছেড়ে, ভিটে মাটি ছেড়ে, ব্যবসা-চাকরি ছেড়ে, জমি-ঘর-দোকান ছেড়ে, হাস-মুরগী, গরু ছাগল ছেড়ে, বন্ধু ছেড়ে, নিজের হাতে লাগানো গাছগুলি ফেলে, নিকানো উঠান, আলপনা আঁকা তুলসি তলা ফেলে চলে যেতে হচ্ছে কেন?
হঠাৎ নাকে চুরুটের গন্ধ লাগতেই কবিতার বই থেকে মুখ তুলতেই দেখি আমাদের রকিং চেয়ারে বসে উদাস নয়নে চুরুট টানছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে সামনে পেয়ে আবেগে গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কোন মতে বলি আপনি আমাদের বাসায়, কি অবাক কাণ্ড। উনি হেসে ওঠেন। গলা দিয়ে তো খুশিতে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। তবু কোন মতো বললাম, আপনাকে সামনা সামনি দেখছি, তাও আমাদের বাসায়! উফ বিশ্বাসই হচ্ছে না। সৌভাগ্য আমার আপনাকে সামনে পেয়ে।
বললেন, কিছু চাই কি তোমার? আমি মাথা নীচু করে ভাবি কি চাইবো আর কি খবরই বা বলবো? উনি তো সবই জানেন, দেশের প্রধান উনি।
তারপর ভাবি কি আছে বলেই ফেলি। চোখ তুলে দেখি উনি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। বললাম চাই, আপনি কোনদিন আর চলে যাবেন না। আমাদের মাঝেই থাকবেন। শুনে উনি হাসলেন কিছুক্ষণ। আচ্ছা এবার কিছু ইন্টারেস্টিং খবর বল।
ভাবি কি খবর দেব। উনি তো সবই জানেন। চট করে দেয়াল লেখনের কথা মনে হল।
ইদানিংকালের দেয়াল লেখনগুলি উনার চোখে পড়েছে? বঙ্গবন্ধুকে বলি, দেয়ালে লেখা সুবোধ তুই পালা কি আপনার চোখে পড়েছে? জানেন দলে দলে সুবোধরা পালাচ্ছে। সুবোধদের পালানো কি বন্ধ হবে না? সুবোধদের মতো আমাদের না একদিন পালাতে হয়, সুবোধদের পাশে কেউ নেই আপনি চলে যাওয়ার পর। সুবোধদের নিয়ে চলে ফুটবল খেলা। সুবোধরা ফুটবল নয়। ওরা আপনার আমার মত এদেশের মানুষ, সমান হকদার।
দেখেছেন পাহাড়ে আগুন, এই আগুন কি কোনদিন থামবে না! আপনি নেই বলে এই আগুনের লেলিহান শিখা বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন। আপনি নেই বলে রাজাকারদের শক্তি গেছে অনেক বেড়ে। প্রায় প্রতি ঘরে আজ একটা করে মৌলবাদী মানুষ পাওয়া যায়।
স্কুল কলেজ কারখানার চেয়ে মাদ্রাসা বেড়ে চলেছে। কেউ দেখার নাই। আপনি কেন চলে গেলেন? যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিলেন, তারা এতো বছর পর আবারো জেঁকে বসেছে আমাদের দেশের উপর। আপনি নাই আপনার অসাম্প্রদায়িক দেশও আর নেই। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে কম্পমান দেশ।
বঙ্গবন্ধু দুঃখ ভারাকান্ত স্বরে বললেন, আমি জানি দেশের কি অবস্থা, তোমরা আশা ছেড় না আশা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মেয়ে সব ঠিক করবেই করবে। জানি ওর চারপাশে অনেক বন্ধুরূপী শত্রু। একা একা সব কিছু করার তো সম্ভব নয়, আমার মতোই ওর চারপাশে চাটুকার, মোসাহেবদের ভিড়। জানি খুব কঠিন কাজ, আরো কঠিন করে তুলেছে সুবিধাবাদী কিছু মানুষ। তারপরও জানি, ও পারবে ঠিকই পারবে। সময় লাগলেও তা ঠিক হয়ে যাবে।
কি পড়ছিলে?
শামসুর রহমানের কবিতা।
কোনটা পড়ছিলে? শোনাও তো।
আমি পড়ি,
আরও জানি বন্ধু সুধাংশু
তোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে নাঃ আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন ?
চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা ।
তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা ।
তোকে যে বলা হয় নি বন্ধু সুধাংশু
মিলা’র সহপাঠী আমার ভাইটি ‘রিপন’ বলছিল সেদিনঃ ভাইয়া মিলা’টা যা সুন্দর হয়েছে না !
বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে,
তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না ।
তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা ।
আমি থামতেই উনি বলেন,
সুবোধদের চলে যাওয়া আমায় কষ্ট দেয়। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারি না।
সুবোধ পালায়, সাদেক দখল করে সুবোধের ঘর বাড়ি। বীনা কাঁদে, মর্জিনা হাসতে হাসতে বীনার ফেলে যাওয়া তুলসি গাছ উপরে ফেলে সেখানে গরু বাঁধার খুঁটি পোতে। কিছু দিন আগেও, সুবোধ-সাদেক গলা ধরে গল্প করেছে, মর্জিনা-বীনা হাসতে হাসতে একে-অপরের সাথে আঁচাড় ভাগ করে খেয়েছে। আজ আমার বাংলায় কিছু মানুষ হিংসা-বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে ছড়াতে, বিষাক্ত করে তুলেছে চারপাশ।
আপনি একটু বলেন না আমাদের নেত্রীকে সাবধান করে দেন, উনার চারপাশে বন্ধু নেই।
আমার মেয়ে সব জানে, তারপরও তাকে বলবো, অবশ্যই বলবো। আমার আদর্শই আমার কথা, আমার মেয়ে কি আর আমার দলের আদর্শের বাইরে যাবে, বল। ও আছে বন্ধুর পথে, চিন্তা করো না, আশা রাখো। এবার কবিতাটা পড়ে শেষ কর।
আমি আবার পড়তে যেতেই ক্রিং ক্রিং করে বঙ্গবন্ধুর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে, উনি ফোন বের করতে করতে বলেন, আমাকে যেতে হবে, সময় হয়ে গেছে একটা মিটিঙের।
আপনি যাবেন না প্লিজ, যাবেন না আমাদের ছেড়ে, বলে চিৎকার করে উঠি। ও মা আমি তো কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি, আর ঘুমের মাঝে স্বপ্নে এসেছিলেন, আমারদের প্রাণপুরুষ, আমাদের মহান নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আমার হাতে দেখি এখনও ধরা কবিতা বই। মনে হলো, ও হো আমার নেতা না বললেন, কবিতাটা পড়া শেষ করতে।
মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশু
অসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবন
হবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা ।
তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)