ডেঙ্গুকে সাম্যবাদী রোগ বলা যেতে পারে। আগে ঢাকা শহরে মশাবাহিত যেসব রোগ এসেছে বেশিরভাগের কোপ পড়েছে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বড়জোর মধ্যবিত্তের ওপর। এই প্রথম এমন একটি রোগের প্রাদুর্ভাব যার পছন্দের মধ্যে গণতান্ত্রিকতা রয়েছে। দুঃখজনকভাবে ডেঙ্গুতে যে মানুষদের মৃত্যু হয়েছে সেই মৃতদের তালিকা দেখলে বোঝা যায় ডেঙ্গু সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো শ্রেণিকেই ছেড়ে দিচ্ছে না।
ডেঙ্গু মশার জন্ম বিনাশে দেশের পরাক্রমশালী পত্রিকা টেলিভিশনগুলো খুব বেশি কিছু করতে না পারলেও এখন তারা এডিস মশার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে। টেলিভিশন খুললে কত ঘণ্টায় কতজন ডেঙ্গু রোগী মারা যাচ্ছে তার ব্রেকিং নিউজ। হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে টেলিভিশন রিপোর্টার ক্যামেরাম্যানদের উৎপাতে চিকিৎসা সেবা ব্যাহতও হচ্ছে। তথাপি দেশ ও জাতির উদ্ধারে তাদের কর্মে কোন ক্লান্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রতিদিন টেলিভিশনে হাজির হয়ে তাদের মুখ নিঃসৃত অমিয় বাণীতে আমাদের ধন্য করছেন। মমতা ব্যানার্জী হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, বাংলাদেশের ডেঙ্গু পশ্চিম বাংলায় গেলে ছেড়ে কথা বলা হবে না।
এডিস নিধনে ত্রাতা পরামর্শকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন কোলকাতার মেয়র। তিনি কোন এলাকায় কত ডেঙ্গু রোগী তার হিসাব রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ দুষ্টুমি করে বলছে, ঢাকার ব্যবস্থাপনা কোলকাতা কর্পোরেশনের কাছে ভাড়া দিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। মেয়রদেরও জবাবদিহি করতে হবে না। গণমাধ্যমগুলোও কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না।
সবার ছুটি বাতিল করে নিজে স্বাস্থ্যভ্রমণে গিয়ে রেহাই মেলেনি মন্ত্রীর। দুষ্টু সাংবাদিকরা এ খবর ভাইরাল করে দিয়েছেন। অগত্যা ভ্রমণানন্দে ছাই ঢেলে কুয়ালামপুর থেকে সোজা মিটফোর্ডে গিয়ে সাংবাদিকদের ধমক দিয়েছেন তিনি।
সাাংবাদিকরা নিরীহ প্রজাতির। তাদের ধমক দিয়ে চুপ করানো গেলেও ডেঙ্গুর ভালোবাসায় কমতি দেখা যাচ্ছে না।
দুষ্টুরা বলে, বছরের পর বছর মশা মারার ওষুধের টাকা নালায় না ফেলে পকেটস্থ করলে এমন তো হওয়ারই কথা ছিলো।
ঢাকা বিশ্বের বাড়ন্ত শহরগুলোর অন্যতম। এখানকার বনানী-গুলশান-বারিধারার রাস্তায় প্রতিদিন সবচেয়ে দামি গাড়িগুলো নামে। চোখের পলকে মানচিত্র বদলে অট্টালিকার সারি ওঠে। একই শহরে আবার রিক্সাওয়ালা তাদের জীবন ধারণের জন্য রিক্সা চালাতে ধর্মঘট করে। রাস্তায় নামে নিরীহ কিশোর। হাসপাতালের বারান্দায় কাতরায় চিকিৎসা সেবা। কামরাঙ্গীচরের বস্তিতে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকে মানুষ। যদিও এমন শহরকে নিয়ে লস এঞ্জেলেস, কানাডা, বেলজিয়াম কিংবা প্যারিস বানানোর স্বপ্নে কমতি নেই নীতি নির্ধারকদের।
এমন বৈষমের শহরে বৈষম্যবিরোধী এডিস মশা। ডেঙ্গু মহামারীকে জয়তু বলা ছাড়া কি করার থাকে???
পাদটীকা: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, যে দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এতটাই স্বাধীন যে ডেঙ্গুর আগাম বার্তা দিয়ে তার ভয়ঙ্কর বর্তমানকে রুখতে কাজ করতে পারেনি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)