Advertisements
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার দক্ষিণ জয়নগরে সি পি আই ( এম) কর্মী ইয়াসিন মিঞার বাড়িতে হামলা করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। বাদল মিঞার বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে ভি এইচ পি। উদয়পুরে মাতাবারি বিধানসভার মুড়াপাড়ার কান্দি এলাকায় বেছে বেছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাড়ি আক্রমণ করছে ভি এইচ পি, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ। জামুরিয়াবাজারে গরিব মাংস বিক্রেতা মনসুর আলির দোকান ভাঙচুর করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। আগরতলা শহরে বিলাসবহুল হুডখোলা গাড়িতে গরু বসিয়ে হিন্দুত্বের ভাবাবেগ ছড়াচ্ছে বর্বর হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা।
আগামী ২৫ নভেম্বর ত্রিপুরাতে পৌর ভোট। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কথার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন ত্রিপুরাতে হিন্দুত্ববাদীদের কর্মকাণ্ডে বন্ধু? বাংলাদেশের অনভিপ্রেত ঘটনার প্রেক্ষিতকে কাজে লাগিয়ে আগামী বছরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরাসহ ভারতের আরও যে কটি রাজ্যের বিধানসভার ভোট হতে চলেছে, সেখানে মেরুকরণের রাজনীতিকে জোরদার করতে আসরে নেমে পড়েছে বিজেপি। তারা যে এই কাজে নামবে, সেটা খানিকটা জানা বোঝার ভিতরেই ছিল। কিন্তু সেই জানাবোঝাটাকে সামাজিক গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এমন কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এখন আসরে নেমেছে, যাদের রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না।
এই ধরণের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথমেই রামকৃষ্ণ মিশনের কথা বলতে হয়। যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ , সেই প্রেক্ষিতের সঙ্গে কতোখানি সাযুজ্য রেখে রামকৃষ্ণ মিশন এখন পরিচালিত হচ্ছে- এই প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়েও বলতে হয় যে, প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনীতি এড়িয়ে গিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ ব্রিটিশ প্রতিরোধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিতে যে পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, তাঁর অকাল মৃত্যু না হলে, মিশনের সঙ্গে বিবেকানন্দের পরবর্তী সম্পর্ক কি দাঁড়াতো , তা ঘিরে একটা সংশয় থেকেই যায়।
রামকৃষ্ণ মিশনের ঢাকা শাখা ‘হিন্দু’ দের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকাতে মানববন্ধন করেছে। মিশনের ঢাকার প্রধান স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ সেই মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে, সাম্প্রদায়িক লেবাস দিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর ধর্মান্ধ মৌলবাদী, পাকিস্থানের হানাদার বাহিনীর সমর্থক দের কর্মকাণ্ডকে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখে কথা বলে গিয়েছেন ওই ভিডিও বার্তায়। সংখ্যালঘুদের পাশে বাংলাদেশ সরকারের যে দৃঢ় অবস্থান, তাকে অনেকখানি লঘু করে দেখে কার্যত একটা রাজনৈতিক বক্তব্য ই রেখেছেন। বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সমাজ সেখানকার আক্রান্ত সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আক্রমণকারী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের তীব্র নিন্দা করেছেন। এইসব কোনো কিছুই রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের কথার ভিতর দিয়ে ফুটে ওঠে নি। কার্যত চিরকালীন রাজনীতি থেকে দূরে থাকার যে অবস্থান রামকৃষ্ণ মিশনের- সেই অবস্থান থেকে শতযোজন দূরে একটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে তাঁদের এই নতুন অবস্থান সমস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে , স্বামী বিবেকানন্দের জীবদ্দশাতেই ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। পরবর্তী সময়ে যিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন, সেই স্বামী শঙ্করানন্দ ও এইপর্বে ভগিনী নিবেদিতার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের একজন কর্মী ছিলেন। বিবেকানন্দের জীবনাবসানের অব্যবহিত পরেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে ধীরে ধীরে নিবেদিতার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি করেছিল রামকৃষ্ণ মিশন। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণ পত্নী সারদামণি দেবী কখনো তাঁর স্নেহচ্ছায়া থেকে দূরে সরিয়ে দেন নি ভগিনী নিবেদিতাকে। স্বদেশী আন্দোলনের ভিতর দিয়ে যেসব মানুষ রামকৃষ্ণ মিশনে এসেছেন, ব্রিটিশ আমলে তাঁদের ঘিরে কিছু সমস্যার ভিতরে রামকৃষ্ণ মিশনকে পড়তে হয়েছিল। ব্রিটিশ রোষানলেও মিশন কে কিছুটা পড়তে হয়েছিল। টেগার্টের গোপন প্রতিবেদনে রামকৃষ্ণ মিশনে বিপ্লবীরা এসে আশ্রয় নিচ্ছেন বলে , মিশন সম্পর্কে ব্রিটিশের উষ্মা এবং বিরক্তি কি ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক লাডলীমোহন রায়চৌধুরীর এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণাও রয়েছে। ব্রিটিশের রোষানল থেকে বাঁচতে মিশনের সেইসময়ের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সারদানন্দকে দৌত্য পর্যন্ত করতে হয়েছিল এবং একটা আপোষ মিমাংসাতে শেষ পর্যন্ত মিশন কর্তৃপক্ষকে পৌঁছতে হয়েছিল।
তারপর থেকে প্রায় একশো বছর সময়কাল ধরে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কোনো অবস্থাতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনীতির ধারপাশ দিয়ে হাঁটে নি। আধ্যাত্মিকতা, শিক্ষা আর সেবাকাজের ভিতরেই তাঁরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল। এই অবস্থার অদলবদল ঘটতে থাকে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিনের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসবার পর। তারপর ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি একদমই বদলে যায়।
অতীতে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস বা বামপন্থীরা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সরকারের কোনো সংঘাত না থাকলেও সরকারের কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে রাজনীতিমেশানো কাজকর্মে রামকৃষ্ণ মিশনকে কখনো ই দেখতে পাওয়া যায় নি। কিন্তু মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই তাঁর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের আবরণে সজ্জিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলিতে রামকৃষ্ণ মিশনকে অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে অংশ নিতে দেখা যায়। সেই সক্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপিকে কেন্দ্র করে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিশেবে যেভাবে বেলুড় মঠের ভিতরে সভা করে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রচার করেন, তেমন দৃষ্টান্ত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে কখনো দেখা যায় নি। বস্তুত আর এস এসের শাখা সংগঠন হিশেবে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের যে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান,সেই অবস্থানে কেবলমাত্র ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ধর্মান্তরিত করবার কর্মকাণ্ড ছাড়া, অন্যান্য ক্ষেত্র বিচারে আর এস এসের শাখা সংগঠনটির সঙ্গে এখন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ব্যবধান নির্নয় করা কার্যত দুস্কর হয়ে পড়েছে।
এই রামকৃষ্ণ মিশন আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন ঘিরে সোচ্চার। যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ই এই পাশবিকতা ঘিরে সোচ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই রামকৃষ্ণ মিশন কি ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তির দানবীয়তা ঘিরে একটি শব্দ উচ্চারণ করে? এন আর সি র প্রতিবাদকে দমিয়ে দিতে ভারতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলেছে দিল্লি গণহত্যাকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর।ভারতে এই সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘিরে একটা শব্দ ও কি রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে একটাবারের জন্যে ও শোনা গিয়েছে? এন আর সি র নাম করে আসামে , সেখানকার বিজেপি সরকার ভারতের নাগরিকদের ই একাংশকে, কেবলমাত্র জন্মসূত্রে ‘ মুসলমান’ হওয়ার কারণে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুড়ে মনুষ্যেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে। তার প্রতিবাদ কি একবারের জন্যেও রামকৃষ্ণ মিশন করেছে? ডিটেনশন ক্যাম্পে অসহায় সহনাগরিক, যাঁরা ধর্মে মুসলমান, তাঁদের কাউকে একথালা ভাত ও এগিয়ে দিয়েছে আজকের এই পরিবর্তিত রামকৃষ্ণ মিশন? ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ত্রাণবিলির ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাছবিচার করে। আজকের পরিবর্তিত রামকৃষ্ণ মিশন তো সেই পর্যায়ের থেকে আর নিজেদের পৃথক করতে পারে না।
বাংলাদেশের নিন্দনীয় ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে সুপ্ত মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর ভিতর দিয়ে সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে দিয়ে হানাদার পাকিস্থানীদের জারজ সন্তানদের যেভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, সেই প্রেক্ষিতে তাঁর কাছে সরাসরি প্রশ্ন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাক্রমের পাল্টা হিশেবে ত্রিপুরাতে আর এস এস মুসলমানদের উপরে যে দানবীয় অত্যাচার অত্যাচার করছে, সে সম্পর্কে আপনি নীরব কেন শঙ্কর মহারাজ? মিশনের পক্ষ থেকে আপনি তো দীর্ঘদিন ত্রিপুরাতে থেকেছেন। তখন ত্রিপুরায় বাম শাসনকাল ছিল। সেই সময়ে কি এতোটুকু সাম্প্রদায়িক অশান্তি সেখানে আপনি দেখেছিলেন শঙ্কর মহারাজ? দেখেছিলেন গরীব সংখ্যালঘু মুসলমান নাগরিকের বাড়ির দরজায় তালা ঝোলানোর স্পর্ধা দেখাচ্ছে রাজনৈতিক হিন্দুরা? হতদরিদ্র মাংস বিক্রেতার দোকান লুঠপাট করছে রাজনৈতিক হিন্দু সন্ত্রাসীরা? কেন ত্রিপুরা নিয়ে একটা শব্দ ও উচ্চারণের সৎ সাহস দেখাতে পারছেন না শঙ্কর মহারাজ? এই বিভাজন কি আপনার আরাধ্য প্রেমের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শের সঙ্গে খাপ খায়? যদি খাপ না খায়, আসুন , মন না রাঙিয়ে বসন রাঙানোর এই ভেক ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। সঙ্গী হোন অজয় বিশোয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘ যোগী’ আদিত্যনাথে। বিবেকানন্দ, বিজ্ঞানানন্দ, বীরেশ্বরানন্দ, আত্মস্থানন্দের প্রতিষ্ঠানের ত্যাগের প্রতীক গৈরিকবসনের অধিকার আপনি হারিয়েছেন। সেই গেরুয়া ছেড়ে নাগপুরের রেশমবাগের ‘কেশবভবনে’ র গেরুয়া পড়ে আপনি মুসলমান বিদ্বেষের রাজনীতিতে নেমে পড়ুন পূর্ণাত্মানন্দজী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)